পৃথিবী প্রতিদিন এগোচ্ছে। পরিবর্তনের সাথে প্রতিযোগিতা দিয়ে প্রজন্ম বদলে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে এভাবে কেন! আমিও এই ভিকারুননিসারই ছাত্রী ছিলাম এবং এই প্রতিষ্ঠান থেকে যেদিন বেরিয়ে এসেছি সেদিনের পর থেকে প্রতিদিন এটাই ভেবে আসছি এই প্রতিষ্ঠানকে রিপ্রেজেন্ট করা আমার দায়িত্ব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভিকারুননিসার আভিজাত্য আর ঐতিহ্য আমাদের বাংলাদেশের বহুদিনের ইতিহাসে একটা তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। দেশ সেরা প্রতিষ্ঠান একদিনে হওয়া যায় না। এই বটবৃক্ষের ছায়ায় বেড়ে ওঠা হাজার হাজার মেয়ে যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক ময়দানে তাদের অভিনব যোগ্যতা আর পারদর্শিতার যথাযথ প্রয়োগ দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান এবং এই দেশকে পরিচিতি দিয়ে আসছে। খারাপও অবশ্যই ছিলো। একটা মেয়ের খারাপ হওয়াটা কখনোই শুধু তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপর নির্ভর করে না। পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক পরিবেশ অবশ্যই দায়ী তাকে ধীরে ধীরে খারাপ করে তুলতে।
আমি ভিকারুননিসার ছাত্রী ছিলাম মাত্র সাত বছর আগে। আমরা তো আমাদের শিক্ষকদের দূর থেকে দেখলেও থেমে যেতাম। মাথা নত রেখে শ্রদ্ধা নিবেদন করতাম। শিক্ষকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ যদি হয় মানুষ গড়া তবে মানবিক ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করা এবং সেই ব্যাপারে যতœ নেয়া কিন্তু শিক্ষকদের গুরুদায়িত্ব। অরিত্রীর কাছে মোবাইল পেয়ে, নকল ধরে শিক্ষক তাকে শাসন করেছেন। তার বাবা মাকে বলেছেন। অরিত্রী আত্মহত্যা করেছে। এবার শুরু হলো আন্দোলন। মেনে নিলাম ব্যাপারটা নিয়ে শিক্ষকের আগানোর পদ্ধতিতে ভুল ছিলো,সঠিক ছিলো না। কিন্তু অরিত্রী কী ভুল করে নি?
অরিত্রী যে মোবাইল নিয়ে পরীক্ষা কক্ষে গেছে, এই শিক্ষা কি তাকে ভিকারুননিসা দিয়েছে? আমরা তো সাত বছর আগে ভাবতে পারিনি এরকম কাজের কথা। মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর প্রথম মোবাইল কিনেছিলাম বাবা মাকে নিয়ে। পড়ালেখার বাইরে যে অন্য একটা পৃথিবী আছে সেই পৃথিবীর সাথে পরিচিত হতে আরও অনেক বছর লেগেছে। আর এখনকার ছেলেমেয়েরা তো স্কুল জীবনে প্রবেশের আগে থেকেই জানে রিলেশনশিপ কি। এখন বিভিন্ন সমীক্ষায় ডিপ্রেশনের কারণ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। আমাদের ঐ বয়সটাতে পড়ালেখা ছাড়া কোনো ডিপ্রেশন ছিলো না। ঘুরে ফিরে পরিবার,পড়ালেখা অর্থাৎ একাডেমিক আর সাংস্কৃতিক জগৎ নিয়েই ভাবনা। অবশ্যই সমাজ,দেশ,পৃথিবী বাদ দিয়ে নয়। সবকিছু মিলিয়ে একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়েই এসেছি। কিন্তু আমরা যদি পিছিয়ে না থাকি, ওরা কি খুব এগিয়ে যাচ্ছে? প্রজন্মের এইভাবে এগিয়ে যাওয়া সমাজকে কতোটা ইতিবাচক দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? তারা ভবিষ্যতে দেশকে কীভাবে পরিচিত করবে পৃথিবীর কাছে? ডিজিটালাইজেশনের প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়াতে প্রজন্ম এভাবে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। আমরা আধুনিক হবো। তবে নিজস্বতার বিসর্জনে ডিজিটালাইজেশনকে স্বাগতম জানানো ভয়াবহ। তাই নিয়ন্ত্রণ আবশ্যিক। এই নিয়ন্ত্রণ রাখাটাও একটা শিক্ষণীয় ব্যাপার। এই শিক্ষাটা ওদেরকে দেয়ার দায়িত্ব কার?
শিক্ষকের ত্রুটি তো ছিলোই। একজন শিক্ষার্থীর ত্রুটিকে তার নিজের কাছে এবং মা বাবার কাছে প্রতিষ্ঠিত করার অবশ্যই একটা সংযত পদ্ধতি আছে। প্রশিক্ষণ এবং কাউন্সেলিং এর একটা বিশাল শূন্যস্থান এখানে সুস্পষ্টভাবেই পরিলক্ষিত। শিক্ষকের এই ভুল নিয়ে আলোচনা করতে গেলে শুধু ভিকারুননিসা আসবে কেন? এটা তো আমাদের দেশীয় সমস্যা। শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি আমাদের জাতীয় সমস্যা। পরিবারকে বাদ দিয়ে এই আলোচনা সম্মুখে যায় কি করে? একজন সন্তানকে মানবিক করে গড়ে তুলতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা তো পরিবারের। সেখানেও তো বড়রকমের একটা ফাঁকা গর্ত। বাবা মার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সাইকোলজিক্যাল স্থিরতায় সবচেয়ে বড় সহায়ক। ঐরকম একটা শেয়ারিং এবং কেয়ারিং- এর মধ্যে বড় হওয়া ছেলেমেয়েগুলো আত্মহত্যার মতো কর্মকা-ে খুব কম লিপ্ত হয়। পরিবার কি সেই পরিবেশ সন্তানদের দিতে পারছে? এতোসব সমস্যার তো একদিনে সমাধান হবে না। একটা আন্দোলনে সমাধান হবে না। পুরো সিস্টেমে যখন সমস্যা সেটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। শিকড় থেকে পরিবর্তন আনতে হবে।
ভিকারুননিসার মেয়েদের অনেক কথা বলতে শুনছি। অনেক ভঙ্গিতে নিজেদের প্রকাশ করতে দেখছি যা আমায় প্রচ- আশাহত করছে। আমরা কখনোই চাই না ভিকারুননিসা এভাবে রিপ্রেজেন্টেড হোক। এরকম ভিকারুননিসা তো আমরা দেখতে চাইনি। দেশের সবচেয়ে সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানকে এভাবে পরিচিত হতে দেখলে শুধু খারাপ লাগে না, ভয়াবহ দুঃখ হয়। দুঃখ শুধু এই প্রতিষ্ঠানের জন্য হয় না। পুরো দেশটার জন্য হয়। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্ত আর এতো এতো মা- বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে কেনা মাটিতে জন্ম নেয়া প্রজন্মকে এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে দেখতে তীব্র দুঃখ হয়।
একটু মোড় ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। সবারই দায়িত্বে সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। যার যার জায়গায় সবাই একটু বদলে গেলেই দেশটা বদলে যাবে। পুরো সিস্টেমটা ধীরে ধীরে বদলে দিতে পারলে আমাদের দেশটা আরও অনেক সুন্দর হয়ে যাবে। চলুন আমরা দেশটাকে একটু ভালোবাসতে শিখি। কোনো অসচেতন মস্তিষ্কে নয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপে সচেতনতা বাড়িয়ে দিলে সত্যিই এই বাংলা একদিন সোনার বাংলা হবে। আমরা আর বসে না থাকি। যে যার স্থান থেকে একটু নড়েচড়ে দাঁড়াই। মানসিকতার একটু পরিবর্তন আনি।
লেখক : চিকিৎসক, কবি, বাচিক শিল্পী