সৈয়দ জাহিদ হাসান : ‘জয়’ আমার প্রিয় শব্দ। আমি সর্বদা জয়ী হতে ভালোবাসি। আমার জীবনের সঙ্গে, জগতের সঙ্গে যে-মানুষগুলো ভালোবাসা-শ্রদ্ধা ও ¯েœহের বন্ধনে বাঁধা আমি চাই তারাও জয়ী হোক। জয় আমার কাছে মহান একটি শব্দের নাম। অভিধানের যেকোনো শব্দের চেয়ে এই শব্দটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আকাক্সিক্ষত ও প্রয়োজনীয়। ‘বাংলা’ আমার মাতৃভাষা, ‘বাংলা’ আমার মাতৃভূমি। আমার অস্তিত্বের সঙ্গে, সহানুভূতিশীল সত্তার সঙ্গে ‘বাংলা’র সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বাংলা আমার কাছে তুলনাহীন শব্দ। পৃথিবীর কোনো শব্দের সঙ্গেই আমি ‘বাংলা’ শব্দটির তুলনা করি না। আমি তুলনা করার শক্তি ও সাহস রাখি না। এই শব্দটির সামনে দাঁড়ালে আমি ভাষা-বাক্য হারিয়ে ফেলি। শ্রদ্ধায়-প্রেমে মাথা নত হয়ে আসে। ‘বাংলা’র পূর্বে ‘জয়’ বসিয়ে আমি যখন ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করি তখন আমার কণ্ঠ ‘কবিকণ্ঠ’ হয়। আমার বক্তব্যের নাম হয় ‘বজ্রকণ্ঠ’। ‘সোনার বাংলা’ বলি আর ‘রূপসী বাংলা’ বলি এগুলো সবই ‘জয় বাংলা’র সমার্থক।
বাংলা ভূখ-ে ‘জয় বাংলা’র বিকল্প স্লোগান কেবল ‘জয় বাংলা’ই হতে পারে। জয় বাংলার প্রতিপক্ষ স্লোগান হিসেবে যারা অন্য স্লোগান দেয়Ñ একজন বাঙালি ও বাংলাদেশি হিসেবে সেই স্লোগান আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমি বিদেশি ভাষা ঘৃণা করি না, ভালোবাসি। বিদেশি ভাষার চেয়ে বেশি ভালোবাসি আমার স্বজাতির ভাষা তথা বাংলা ভাষা। ‘জয় বাংলা’ আর ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ একই অর্থ প্রকাশ করলেও ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ আমার পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। কেননা, এই সাম্প্রতিক স্লোগানটি আমাদের অনেক বড় ইতিহাসকে চিরতরে ভুলিয়ে দেবার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই স্লোগানটি দূরভিসন্ধিমূলক, প্রতারণাপূর্ণ, সুযোগ সন্ধানীদের স্লোগান। এই স্লোগান কণ্ঠে ধারণ করা মানে নিজেকে স্বাধীন বাংলার নাগরিক বলে অস্বীকার করা, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াকু ইতিহাস ও আত্মত্যাগকে অস্বীকার করা।
‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি দুই শব্দের একটি অসামান্য ‘মহাকাব্য’। এত ছোট, কিন্তু এত তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগানের মহাকাব্য পৃথিবীর আর কোনো জাতি রচনা করতে পারেনি। অথচ কী আশ্চর্য, জয় বাংলা বলতে আজ বাংলাদেশের অনেক মানুষই দ্বিধান্বিত। অনেকেই মনে করেন ‘জয় বাংলা’ তাদের স্লোগান নয়, তাদের স্লোগান ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান’, ‘নারায়ে তাকবির...’ কিংবা ওই জাতীয় অন্য কোনো কথা। এমনটি কেন হলো? এমনটি কি হওয়ার কথা ছিল? আজ চারদিকে ঐক্যের কথা শোনা যাচ্ছে। এক্য, ঐক্য বলে অনেকেই আজ গলা ফাটিয়ে ফেলছেন, যারা আজ বৃহত্তর ‘জাতীয় ঐক্যে’র নামে এক হয়েছেন বলে বাংলাদেশের বহুবিভক্ত জনগণকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন, তাদের কাছে আমার জানতে ইচ্ছে করেÑ ‘জয় বাংলা’ বাদ দিয়ে কি ‘জাতীয় ঐক্য’ সম্ভব? নাকি ‘জাতীয় ঐক্য’ হতে পারে?
ঐক্যের নামে যদি প্রতারণা করার অভিলাষ না থাকে তাহলে ঐক্য-আকাক্সক্ষীদের অনুরোধ করতে চাই, আপনারা ‘জয় বাংলা’ ধারণ করুন। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়েই আপনারা বাংলার পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়–ন। আজ যারা ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করার পণ করেছেন, তারা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনে আপনারা ‘জয় বাংলা’ বলেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, অন্যকেও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এখন যদি সত্যিকার অর্থেই ঐক্য চান, তাহলে আজ আপনাদের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ বলতে অনাগ্রহ কেন? তাহলে কি আপনারা ‘জয় বাংলা’র বিরুদ্ধেই ঐক্য করতে চাচ্ছেন?
‘জয় বাংলা’ অবরুদ্ধ করে, অস্বীকার করে, জাতীয় ঐক্যের পথে হাঁটা ভয়ঙ্কর বোকামি হবে। এর পরিণামও হবে ভয়াবহ। বাংলাদেশের মানুষকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই একটি অপশক্তি ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এখনো সেই ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় দুটোই আমাদের অহংকার। ‘জয় বাংলা’ বার বার এই অহঙ্কারের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। আমরা অনেক বিভাজন দেখেছি, বিকৃতি দেখেছি, ভ্রাতৃঘাতী বর্বরতা দেখেছিÑ আর এসব দেখতে চাই না। আমরা দেখতে চাইÑ ‘জয় বাংলা’র বিকল্প কেবল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান।
লেখক : কবি ও কথাশিল্পী
syedjahidhasan29@gmail.com
আপনার মতামত লিখুন :