এম. আমান উল্লাহ, কক্সবাজার: গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এই পর্যন্ত ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক নারী এবং ৫৮ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার গতি ও মাত্রায় এটি বিশ্বে দ্রুততম ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সংকট সৃষ্টি করেছে।
মানবিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয়সহ সার্বিক সহায়তা প্রদান করে। এর আগেও বাংলাদেশে ৪ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছিল। সব মিলিয়ে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১১ লাখের বেশি।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের একাংশ নানা কৌশলে দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিশে যাওয়ায় শরণার্থীর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন ও জীবন যাপন দেশের বিশেষ করে টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্রগ্রাম এলাকার বনাঞ্চলসহ প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
বিভিন্ন খাতে বিশেষ করে প্রশাসনিক, অবকাঠামো ও পরিবেশ উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা এবং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার ব্যয় বেড়ে চলেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক প্রভাব এখনই যথোপযুক্তভাবে মোকাবেলা করা না হলে তা ব্যাপক ভৌগোলিক এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি, অপরিবর্তনীয় পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে জানান পরিবেশবাদী নেতারা।
বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১১টি স্থানে পাহাড় ও বন কেটে মোট চার হাজার ৮৫১ একর বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় এক লাখ ৬৫ হাজার আশ্রয় ক্যাম্প ও বিভিন্ন অবকাঠামো। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার ১৫৬ একর সংরক্ষিত বনভূমি এবং যেখানে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রোহিঙ্গারা পাহাড়ি বনভূমির গাছ-বাঁশ কেটে তৈরি করছে ঘর-বাড়ি। আর বনের কাঠ ব্যবহার করছে জ্বালানি কাজে। এতে উজাড় হচ্ছে উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজারের বনাঞ্চল। বনভূমির গাছ কাটা এভাবে চলতে থাকলে খুব শিগগিরই উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে হারিয়ে যাবে বন।
জ্বালানি কাঠের এই চাহিদা পূরণে পর্যায়ক্রমে বৃহত্তর চট্রগ্রামের বনভূমিও ধ্বংস হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, গাছপালা কাটার কারণে পাহাড় ধস বেড়ে যাবে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। পাহাড় ও বন ধ্বংসের ফলে ইতিমধ্যেই পাহাড় ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।
ইউএনডিপির তথ্য অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের ৬০ হাজার হেক্টর বনভূমির ২৬ হাজার ৬৬০ হেক্টরের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ক্যাম্পের চারপাশের ১০ কিলোমিটার বনাঞ্চল থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে আনুমানিক একবছর জ্বালানি সরবরাহ করা যাবে। কিন্তু ২৬ হাজার ৬৬০ হেক্টরের পুরো বনভূমিই ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং তা কম জৈববস্তুপুঞ্জ ও উৎপাদনশীলতা সম্পন্ন লতা-গুল্ম-ঝোপ এলাকায় রূপান্তরিত হবে। বনভূমি থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে, তা প্রস্তাবিত ইনানী ন্যাশনাল পার্ক এবং হিমছড়ি ন্যাশনাল পার্কের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। রোহিঙ্গা এবং তাদের ক্যাম্পের কারণে কক্সবাজারের ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠস্থ পানি, মাটি, প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য, জীববৈচিত্র্য এবং বন্যপ্রাণীর উপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
পুরাতন রোহিঙ্গাদের রান্নার কাজে জ্বালানির ব্যবস্থা থাকলেও নতুনদের জ্বালানি কাঠের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হচ্ছে। তাদের রান্নার কাজে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। যা মাসে ২১ হাজার এবং বছরে দুই লাখ ৫২ হাজার টন। যার বেশির ভাগই আসছে সংরক্ষিত বনভূমি থেকে। উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার এলাকার সামাজিক বনায়ন ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বনভূমির সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দা এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে সামাজিক দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাবে। শুরুতে মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও এখন উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজারের স্থানীয় জনসাধারণ তাদের ওপর ক্ষুব্ধ। স্থানীয় ৫ লাখ জনগণের দ্বিগুণেরও বেশি রোহিঙ্গাদের কারণে সীমিত সম্পদের উপর ব্যাপক চাপ পড়ার ফলে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদেরকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গত বছরের আগস্টে রোহিঙ্গারা আসা শুরু হলে স্থানীয় প্রশাসন নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়।
এখন পর্যন্ত সেই নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যাতায়াত খরচও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাসহ স্থানীয় জনগণ এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে সামাজিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে।
তবে কক্সবাজার জেলা বন কর্মকর্তা মো. আলী কবির বলছেন, উখিয়া রেঞ্জে কুতুপালং, থাইংখালী ও আশপাশের পাহাড়ের প্রায় তিন হাজার একর জায়গায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে৷ এছাড়া টেকনাফ রেঞ্জে ৪৫০ একর, পুটিবুনিয়া রেঞ্জের ৫০ একর এবং শিলখালী রেঞ্জের ৩৭৫ একর পাহাড়ি বন কেটে রোহিঙ্গা বসতি করা হয়েছে৷
কক্সবাজার এলাকার পাহাড় ও বন গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. দানেশ মিয়া৷ এই অধ্যাপক বলেন, ‘‘পরিবেশ এবং বনভূমির কথা চিন্তা করলে রোহিঙ্গাদের জন্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ৷ সবাইকে রান্না করে খেতে হচ্ছে৷ এক লক্ষ চুলা যদি থাকে, সেই এক লক্ষ চুলার জন্য প্রতিদিন যদি ন্যূনতম পাঁচ কেজি জ্বালানি ধরি, তাহলে প্রতিদিন পাঁচ লক্ষ কেজি কাঠ পুড়ছে৷ এগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের উখিয়া টেকনাফের জঙ্গল থেকে যাচ্ছে৷ এই অবস্থা অব্যহত থাকলে বনভূমির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে৷''