ফাহিম ফয়সাল: মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব লায়লা জেসমিন বলেছেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইনের বিধিমালা ইতোমধ্যে জারি করা হয়েছে। এই বিধিমালায় অপরিণত বয়সে বিবাহের ক্ষেত্রে শুধু পিতা-মাতার মতামত না, এর সঙ্গে আদালতকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ আয়োজিত ‘বাংলাদেশ শিশু প্রতিশ্রুতি ও অগ্রগতি ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
লায়লা জেসমিন বলেন, বাল্য বিবাহ নিরোধ করতে সচেতনতা বড় বিষয়। সমাজের সব অসঙ্গতি শুধুমাত্র আইন বা বিধি বিধান দিয়ে দূর করা যায় না। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইনের বিধিমালা ইতোমধ্যে জারি করা হয়েছে। এই বিধিমালায় অপরিণত বয়সে বিবাহের ক্ষেত্রে শুধু পিতা মাতার মতামত না, এর সঙ্গে আদালতকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। পিতা-মাতা এবং আদালতের মতামতের ভিত্তিতে অপরিণত বয়সে বিবাহের ক্ষেত্রে সম্মতি পাওয়া যাবে। দুজনেরই একমত হতে হবে, তা না হলে বিয়েটা হবে না। দুই পক্ষের এক পক্ষ অমত দিলে এখানে বিয়ের কোনও সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে অনেকগুলো কারণের মধ্যে দারিদ্রতা একটি বড় বিষয়, শিক্ষা আরেকটি বড় বিষয়। আমরা আমাদের সমাজে যখনই একটি মেয়ের নিরাপত্তার অভাব বোধ করি, তখনই আমরা অল্প বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেই। একজন দরিদ্র বাবা-মা’র জন্য নিরাপত্তা একটা বড় বিষয়।
এর আগে অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’র চাইল্ড রাইটস গভরন্যান্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রটেকশন ম্যানেজার রাশেদা আক্তার বলেন, ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী পরিসংখ্যানগত দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বাল্য বিবাহ হয় এবং সারা পৃথিবীতে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ইউনিসেফের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের শতকরা ৫৯ শতাংশ মেয়ে শিশুর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে। চাইল্ড রাইটস এডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশের ১৯ টি জেলা থেকে ৮৫ টি কেস স্টাডি বিশ্লেষণ করে জানা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ শিশুর বিয়ে হয়েছে ১৪-১৬ বছর বয়সে এবং মাত্র ৭ শতাংশ শিশুর বিয়ে হয়েছে ১৭-১৮ বছর বয়সে। বাল্যবিবাহের কারণে অধিকাংশ মেয়ে শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্তর পার হতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, এসব কেস স্টাডি পর্যালোচনা করে বাল্য বিবাহের কারণ হিসেবে দেখা যায় এখনও মেয়ে শিশুর প্রতি সামাজিক, গতানুগতিক, বদ্ধমুল ধারণা- মেয়ের বয়স হয়েছে, সুপাত্র, যৌতুক, সামাজিক চাপ ইত্যাদি কারণে ৪২ শতাংশ, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ২৩ শতাংশ এবং অনিরাপত্তাকে দায়ী করেছেন ৬ শতাংশ পিতামাতা। এসব কেস স্টাডি থেকে আরও দেখা যায়, বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে ৮৫টি কেসের মধ্যে ৫৬ শতাংশ বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে। কিন্তু রেজিস্ট্রিকৃত বিয়ের বয়স প্রমাণের জন্য জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট ব্যবহার করা হয়নি।
এছাড়া প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, শিশুদের জন্য পৃথক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উন্নয়নের অগ্রগতি সামান্য, শিশু বান্ধব বাজেট শিশুদের জন্য অংশগ্রহণমূলক নয়, জন্মনিবন্ধনে এখনও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি উদ্বেগের বড় কারণ, সব শিশুর শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি এখনও চ্যালেঞ্জ, শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের অধিকার এখনও কম গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর ওপর সহিংসতার ক্ষেত্রে উদ্বেগের বড় বিষয় হলো শিশু ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি। এ ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতা পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ ও শিশুর কর্মস্থলে সবক্ষেত্রেই সমান ভাবে চলছে। পরিস্থিত পর্যালোচনা কারণ হিসেবে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে যেমন দায়ী করা যায়,ঠিক তেমনি শিশুর প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবও অনেকাংশে দায়ী। প্রতিবেদনে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের বিশেষ বিধানের সম্ভাব্য অপব্যবহার রোধে বিধিমালায় সঠিক দিক নির্দেশনা সহ ১২টি সুপারিশ করা হয়।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা শাহ্নাজ রহমান, এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা সৈয়দ মতলুব রশীদ প্রমুখ।