কাকন রেজা : ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের চেচুয়া বিল, যে বিলের পানি নিয়ে ঘটে গেছে তুলকালাম কা-। এ বিলের পানি সর্বরোগহারী, যা পান করলে বা তাতে গোসল করলে ঘটবে সকল রোগ থেকে মুক্তি, এমন রটনায় ছুটে গেছে হাজারো মানুষ।
পান করেছে সেই বিলের নোংরা পানি, বোতলে ভরে নিয়ে গেছে বাড়িতেও। পক্ষাঘাত আক্রান্ত বা অন্য রোগে চলৎশক্তিহীন রোগিদের গোসলের নামে চোবানো হয়েছে সেই পচা পানিতে। স্বভাবতই বিষয়টি গণমাধ্যমের নজরে এসেছে। রিপোর্টাররা রিপোর্ট করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। তবে আঙ্গিক বিভিন্ন হলেও সব রিপোর্টের মূল সুর একটাই। মূলত কুসংস্কারের মধ্যেই আটকে থেকেছে সেই সুর। যে সুরের নিচে চাপা পড়েছে প্রয়োজনীয় অন্যদিকগুলো। কেউ প্রশ্ন করেননি, শুধু কুসংস্কারের বশে, না মানুষের ছুটে যাবার পেছনে অন্য কারণও রয়েছে। কারা ছুটে যাচ্ছেন ওই বিলে? যারা যাচ্ছেন তাদের সিংগভাগই নিম্নবিত্ত মানুষ। যাদের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’, হাজার টাকায় ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য যাদের নেই। সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থাতো মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমগুলো জানান দেয়। বিকল্প হিসাবে স্কয়ার, অ্যাপোলোর মতন হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা এমন মানুষদের কাছে স্বপ্নের মতন, যে স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না।
সুতরাং কোথায় যাবে তারা, ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কী? উপায়হীন মানুষই অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করে। কুসংস্কারের কথা বলতে গেলে, বিশ্বাসের এমন কারণগুলোও ভেবে দেখতে হবে। বলতে পারেন, অনেক অবস্থাপন্ন আর শিক্ষিত মানুষরাও তো যান। হ্যাঁ, যান।
তাদের মধ্যে কেউ যান মিরাকলের আশায়, কেউ যান যদি সত্যি হয়েই যায় এমন ভাবনায়, একটা অংশ যায় স্রেফ কুসংস্কারের বশে। কুসংস্কার তো শুধু গরীব আর অশিক্ষিতের সম্পদ নয়। চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম। এই অধিকার নিশ্চিত হলে কুসংস্কারের এমন প্রবণতারও নিশ্চিত সংস্কার হবে।
আর যেটুকু থাকবে তা শুধু আমাদের দেশে নয় উন্নত দেশগুলোতেও আছে। ‘কাউন্ট ড্রাকুলা’ই তার প্রমাণ।
এত গেলো চিকিৎসার কথা, এ ঘটনার আরেকটি দিক রয়েছে। চেচুয়া বিলের পানি সর্বরোগহরা এমন রটনাকে কী বলবেন, নিশ্চিত গুজব। আর এই গুজব ছড়েছে মানুষের মুখে মুখে।
অবস্থা যখন তুলকালাম, হাজারো মানুষ ছুটছে চেচুয়ায়, তখনই সামাজিক ও গণমাধ্যমগুলোর ঘুম ভেঙ্গেছে। অর্থাৎ বাস্তবতা বলে, গুজব ছড়তে ডিজিটালমাধ্যম লাগে না। অনলাইনভিত্তিক মাধ্যম আসার আগেও, বুড়া পীর, বাচ্চা পীর, অলৌকিক গাছ এমনসব রটনায়-গুজবে হাজার হাজার মানুষ ছুটে গেছে। অতএব গুজব ছড়ানো নিয়ে যারা সামাজিক ও গণমাধ্যমের প্রতি বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ তারা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন।
মাধ্যমগুলো হলো একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গুজব ছড়লে তার বিপরীতে যুক্তি দিতে পারে মানুষ। গুজব যেহেতু যুক্তিহীন, যুক্তির সামনে গুজবও মূল্যহীন। বরং এতে মানুষ আরো সচেতন হয়, সত্যিটা বুঝতে সমর্থ হয়।
বিপরীতে মুখে মুখে ছড়ানো গুজব, চেচুয়ার বিলে ছুটে আসা মানুষের মতন যুক্তিহীন, প্রতিরোধহীন। সুতরাং যারা গুজব ছড়ানোর দায়ে এবং সিকিউরিটিজনিত শংকায় মাধ্যমকে শৃংখলিত করার স্বপক্ষে, এমন ভাবনাগুলো তাদের মাথায় রাখা দরকার।