 ডেস্ক রিপোর্ট : বিদেশে পাচার ও চুরির ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ দ্রুত ফেরত আনতে সংশোধন হচ্ছে ‘পারস্পরিক সহায়তা আইন।’ নিয়মের তোয়াক্কা না করে কিছু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা নানাভাবে এ বিশাল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। অনুমোদন ছাড়াই তারা এ অর্থের বড় অংশ বিনিয়োগও করেছেন বিদেশে।
ডেস্ক রিপোর্ট : বিদেশে পাচার ও চুরির ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ দ্রুত ফেরত আনতে সংশোধন হচ্ছে ‘পারস্পরিক সহায়তা আইন।’ নিয়মের তোয়াক্কা না করে কিছু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা নানাভাবে এ বিশাল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। অনুমোদন ছাড়াই তারা এ অর্থের বড় অংশ বিনিয়োগও করেছেন বিদেশে।
এ ধরনের অনুমতি ছাড়া বিদেশে সেকেন্ড হোম, হোটেলসহ নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নামে পাচারকৃত অর্থ এ আইনের আওতায় ফেরত আনা হবে। ইতিমধ্যে এ ধরনের ৪৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) এদের প্রকৃত পরিচয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক হিসাব চিহ্নিত করা হয়েছে ৩৯ ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। রিজার্ভ চুরি টাকাও এ আইনের আওতায় ফেরত আনা হবে। আইনটি কাজে লাগানো হবে বিদেশে পলাতক বাংলাদেশি অপরাধীদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও।
এজন্য সংশোধিত আইনে বহির্বিশ্বে সহায়তা চাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালন করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ কর্তৃপক্ষকে সহায়তার জন্য আলাদা সেল গঠন করা হবে। পাশাপাশি একজন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে একটি উপদেষ্টা বোর্ড কাজ করবে। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে আইনের সংশোধনী আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দ্রুত সংশোধনের পর আইন মন্ত্রণালয়কে প্রজ্ঞাপন জারির তাগিদ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সংশোধিত আইনের মাধ্যমে অনুমোদন ছাড়া যেসব ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলের নেতা বা প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগ করেছে তাদের শনাক্ত করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট পাচারের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করবে। বিদেশে সেকেন্ড হোম নির্মাণ, হোটেল ব্যবসায় বিনিয়োগ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, বিদেশে কেনাকাটাসহ নানাভাবে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা করা হবে। এরপর আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের কাছে সহায়তা চাইবে। পাশাপাশি উভয় দেশ অপরাধীদের ব্যাপারে তথ্য আদান-প্রদান এবং সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এ প্রসঙ্গে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, আইন সংশোধনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের কাজ সম্পাদন সহজ হবে। আমার মতে, এটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। বিদ্যমান আইনে একাধিক কর্তৃপক্ষ থাকায় পাচার ও চুরির টাকা ফেরত আনতে বিলম্ব হচ্ছিল। দ্রুত টাকা দেশে আনার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা দূর হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পারস্পরিক সহায়তা আইনে কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে একটি কর্তৃপক্ষ নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি)। তাদের মূল্যায়ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, পারস্পরিক সহায়তা আইনের দুটি কেন্দ্রীয় সংস্থার কার্যক্রমের সুনির্দিষ্ট কার্যপরিধি, পদ্ধতি ও নথির ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে নেই। অপর কর্তৃপক্ষ অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসেও পর্যাপ্ত লোকবল নেই। এতে আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব হচ্ছে। এপিজিও আইনে দুটি কর্তৃপক্ষের বিপরীতে একটি স্থাপনের সুপারিশ করেছে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ব্যবসায় বিনিয়োগ এবং বিদেশে সেকেন্ড হোমের নামে গত দশ বছরে (২০০৪-২০১৪) অবৈধভাবে বাংলাদেশ ছয় লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে এই টাকা পাচার করেছেন। এজন্য তাদের অধিকাংশই অনুসরণ করেছেন প্রায় অভিন্ন পদ্ধতি। পণ্য জাহাজীকরণের কাগজ জাল করে এলসিকৃত পণ্যের পুরো টাকায় তুলে নিয়ে বিদেশে রেখে দিচ্ছেন। আমদানি-রফতানি পণ্যের মূল্য ঘোষণায় কারচুপি এবং মূলধনী যন্ত্রাংশ আমদানির নামে নানাভাবে তারা অর্থ পাচার করছেন। পাচারকৃত অর্থ দিয়ে বিদেশে হোটেল নির্মাণ, জমি ক্রয়, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঘরবাড়ি নির্মাণসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন অনেক অসাধু ব্যবসায়ী। প্যারাডাইস পেপারেও এ ধরনের বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নাম এসেছে। এদের মধ্যে ৪৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) এদের প্রকৃত পরিচয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক হিসাব চিহ্নিত করা হয়েছে ৩৯ ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু আইনগত ত্রুটির কারণে এতদিন এসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে তথ্য আদান-প্রদানেও সমস্যা হয়েছে। ফলে টাকা ফেরত আনতে বিলম্ব হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) রিপোর্টেও গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। এজন্য প্রতিটি ঘটনায় মামলাও হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে অর্থ ফেরত আনা এবং আইনি সহায়তা পেতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছে সহায়তা চাওয়া হয় মূলত অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা আইনের মাধ্যমে। কিন্তু এই আইনের কিছু জটিলতার কারণে বিদেশের সহায়তা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বৈঠক করে বিদ্যমান আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আর্থিক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান, স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দিন, আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক।
জানা গেছে, এ আইনের দুর্বলতার কারণে রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত আনতেও সমস্যা হচ্ছে। চুরি হয়েছে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার। ফেরত এসেছে এক কোটি ৬৫ লাখ ডলার। এখনও ৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলার ফেরত আসেনি। এ পরিমাণ অর্থ ফেরত আনতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। আর মামলা ও টাকা ফেরত আনতে এ আইনের সংশোধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একটি সূত্র জানায়, আইনটি সংশোধন ছাড়াও অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মূলত এই কমিটি সংশোধিত আইনে চুরি ও পাচারের টাকা ফেরত আনার জন্য যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ হচ্ছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় কার্যপদ্ধতিও তৈরি করবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা এ কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করবেন। প্রসঙ্গত বিদ্যমান পারস্পরিক সহায়তা আইনে দুটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ছিল। একটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অপরটি অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস। একাধিক কর্তৃপক্ষ থাকায় অন্য দেশের সহায়তা আদান-প্রদানে জটিলতা দেখা দেয়। এতে টাকা ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হচ্ছে। জানা গেছে, ২০০৭ সালে জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে (ইউএনসিএসি) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সরকার। ২০১২ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিকভাবে সংঘটিত অপরাধবিরোধী কনভেনশনে (ইউএনটিওসি) স্বাক্ষর করেছে সরকার। সেখানে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। পাশাপাশি থাইল্যান্ড ও ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক সহায়তা চুক্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্তণালয়কে দায়িত্ব দেয়া হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা আইনে জটিলতার কারণে বহুল আলোচিত রিজার্ভ চুরি ও বিদেশে পাচারের অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হচ্ছে। পাশাপাশি বিদেশে পলাতক বাংলাদেশি অপরাধীদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ জটিলতার কারণে উল্লিখিত ক্ষেত্রে বিদেশের সংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে দ্রুত সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। সার্বিক এ অনিশ্চয়তা কাটাতে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে ‘অপরাধবিষয়ক পারস্পরিক সহায়তা আইনের। যুগান্তর
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
