এলড্রিক বিশ্বাস : বড়দিন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য একটি আনন্দের দিন। প্রতি বৎসর ২৫ ডিসেম্বর এ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যের সাথে পালন করা হয়। বড়দিন হিসেবে দিনটি বড় নয় কিন্তু মানব জাতির মুক্তিদাতা প্রভু যীশু খ্রিস্টের জন্মদিবস হিসেবে প্রতি বছর দিনটি একটি মহৎ দিন হিসেবে সবার নিকট পরিচিত। দুই হাজার ১৭ বৎসর আগে এক অনাড়ম্বর পরিবেশে মুক্তিদাতা প্রভু যীশু খ্রিস্ট ২৫ ডিসেম্বর কনকনে শীতের রাতে বেৎলেহেমের এক গোয়াল ঘরে জন্মেছিলেন। তার জন্মের আগমনী বার্তা ভাববাদীর দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল যা পবিত্র বাইবেলে উল্লেখ আছে। ভাববাদীর বাণী : ভাববাদী যোহন প্রভু যীশু খ্রিস্টের আগমনী বাণী প্রচার করেন। যেমন যিশাইয় ভাববাদী বাক্য গ্রন্থে লিখা আছে, ‘প্রান্তরে একজনের রব সে ঘোষণা করিতেছে, তোমরা প্রভুর পথ প্রস্তুত কর, তার রাজপথ সকল সরল কর।’ (পবিত্র বাইবেল-লূক : ৩ অধ্যায় ৪ পদ) যীশু যোহন দ্বারা বাপ্তাইজিত হওয়ার জন্য গালীল হতে যর্দ্দনে আসিলেন। বাপ্তাইজিত অর্থাৎ দীক্ষ্মাস্নান নেওয়া। তখন জর্ডান নদীর তীরে অনেকে এসে দীক্ষ্মাস্নান নিত। ‘পরে যীশু বাপ্তাইজিত হয়ে অমনি জল হতে উঠলেন; আর দেখ তার নিমিত্ত স্বর্গ (আকাশ) খুলে গেল এবং ঈশ্বরের আত্মাকে কপোতের ন্যায় নামিয়া আপনার উপরে আসতে দেখলেন। আর দেখ স্বর্গ হইতে এই বাণী হলো ‘এই আমার প্রিয় পুত্র, এতে আমি প্রীত।’ (পবিত্র বাইবেল-মথি : ৩ অধ্যায় ১৬-১৭ পদ)।
যীশুর জন্ম বিষয়ে বাইবেলীয় ব্যাখ্যা : প্রভু যীশুর মাতা কুমারী মারীয়া যীশুর পিতা যোশেফের বাগদত্তা ছিলেন। মারীয়ার বিষয়ে যোশেফ জানতে পেরে তাকে গোপনে ত্যাগ করার মানস করলেন। যোশেফ এই সকল ভাবিতেছিলেন ‘এমন সময় এক দূত স্বপ্নে তাকে দর্শন দিয়া কহিলেন যোসেফ দায়ুদ সন্তান, তোমার স্ত্রী মরিয়মকে গ্রহণ করিতে ভয় করিও না, কেনানা তার গর্ভে যা জন্মেছে, তা পবিত্র আত্মা হতে হয়েছে, আর তিনি পুত্র প্রসব করবেন এবং তুমি তার নাম যীশু (ত্রাণকর্তা) রাখবে; কারণ তিনিই আপন প্রজাতিগকে তাদের পাপ হতে ত্রাণ করিবেন।’ (পবিত্র বাইবেল-মথি : ১ অধ্যায় ১৯-২১ পদ) ‘দূত মরিয়মকে বললেন’ মরিয়ম ভয় করো না। কেননা তুমি ঈশ্বরের নিকটে অনুগ্রহ পেয়েছ। আর দেখ তুমি গর্ভবতী হয়ে পুত্র প্রসব করবে। তিনি মহান হবেন, আর তার নাম যীশু রাখবে’। (পবিত্র বাইবেল লূক : ১ অধ্যায়, ৩০-৩১ পদ) বাংলাদেশে বড়দিন : ডিসেম্বর মাস থেকে খ্রিস্টান সম্প্রদায় বড় দিনের প্রস্তুতি পর্ব শুরু করে এবং ২৫ ডিসেম্বরের পূর্বে ৪ সপ্তাহকে আগমনকাল হিসেবে চিহ্নিত করে আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। বড়দিনের ১ সপ্তাহ পূর্বে আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির সাথে ক্যারল গান বা কীর্ত্তনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে খ্রিস্টের আগমনী বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়।
২৪ ডিসেম্বর রাতের বিশেষ প্রার্থনায় খ্রিস্টের জন্মবারতা ঘোষিত হয়। বিভিন্ন পরিবারে ২৪ ডিসেম্বরের বিশেষ প্রার্থনায় যোগদানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ২৫ ডিসেম্বর প্রার্থনায়ও অনেকে যোগদান করে। পরে বিভিন্ন গৃহে গিয়ে কুশল বিনিময় করে। বড়দিনের প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। এই বিশেষ দিনটিতে ধনী নির্ধনী সবাই ভাল খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে থাকে ও আত্মীয় প্রতিবেশী সবার বাড়িতে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। ছোট শিশুরা গোয়াল ঘর বানিয়ে খ্রিস্টের জন্মচিহ্ন রাখে এবং ক্রিসমাস ট্রি, ক্রিসমাস কার্ড দ্বারা, আলোকদ্বারা, কাগজের দ্বারা ঘর সাজিয়ে বড় দিনকে আরও আনন্দঘন করে থাকে। থাকে কীর্ত্তন গান, হরেকরকম পিঠার আয়োজন, পায়েস, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্মরণিকা প্রকাশসহ অনেক আযোজন। অনেক পরিবারে পশ্চিমা ঐতিহ্যকে সামনে রেখে ‘ক্রীসমাস ট্রি’ সাজানো হয় ছোটদের জন্য ‘সান্তাপাপা’ বানানো হয়।
আনন্দানুষ্ঠানের জন্য শহরকেন্দ্রিক প্রায় পরিবারে কেকসহ হরেক রকম নাস্তার আয়োজন থাকে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে থাকে পিঠার সমাহার। বিভিন্ন গ্রামে যেখানে খ্রিস্টানদের আধিক্য বেশি সেখানে ২৪ ডিসেম্বর রাতে বিশেষ প্রার্থনার পর হয় কীর্ত্তন বা নাটক। এ ছাড়া ২৫ ডিসেম্বর থেকে সপ্তাহব্যাপী থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা। এ দিনটি বিশ্বব্যাপী যেমন পালিত হয় তদ্রুপ বাংলাদেশেও আনন্দ উৎসবে পালিত হয়। কিন্তু খ্রিস্টের জন্ম ও তার ক্রুশীয় মৃত্যুর প্রকৃত তাৎপর্য মানুষের পাপ কালিমা মুছে যাওয়া, সৎ-জীবন যাপন, অন্যায় অত্যাচার বন্ধ করা, ন্যায্যতা আনায়নসহ পিতা ঈশ্বরের প্রতি গভীর বিশ্বাস স্থাপন করতে মানব জাতি ফি বছর পালন করছে বিশ্বব্যাপী শুভ বড়দিন উৎসব। বড়দিন মানে বহ্যিকতা নয়, বড়দিন খ্রিস্টকে গভীর ভাবে আমাদের অন্তরে গ্রহণ করার দিন। তবেই আসবে বড়দিনের স্বার্থকতা।
লেখক : এলড্রিক বিশ্বাস, নির্বাহী সম্পাদক, নফপযৎরংঃরধহহবংি.পড়স
সম্পাদনা : খন্দকার আলমগীর হোসাইন