সাজিদ : অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হয়েছে আগেই। তবে চার লেনের এ মহাসড়কেই দুই লেনের সেতু পার হতে হচ্ছে যানবাহনকে। দুই লেনের মেঘনা সেতুর টোল আদায়ে আবার বসানো হয়েছে আটটি বুথ। এ দুইয়ে মিলে বাড়িয়ে দিচ্ছে মহাসড়কটির যানজট। শুধু মেঘনা সেতু পার হতেই একেকটি যানবাহনের ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা বাড়তি সময় লাগছে। যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ থাকলে সময় লাগছে আরো বেশি।
গতকাল সরেজমিন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মেঘনা সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আট টোলবুথ থেকে মিনিটে তিন-চারটি গাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। টোলবুথ অতিক্রমের পর সেতুতে ওঠার আগে এসব যানবাহন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। টোলপ্লাজায় ঢোকার আগেও কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট চোখে পড়ে।
চালুর পর মেঘনা সেতুতে টোলবুথ ছিল চারটি। চলতি বছরের ২২ জুলাই সেতুতে ডিজিটাল টোল আদায় পদ্ধতি উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। যানজট কমাতে ওইদিনই অতিরিক্ত বুথ বসানোর ঘোষণা দেন তিনি। এরপর কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে বসানো হয় আরো চারটি বুথ। গত সেপ্টেম্বরে চালু হয় এসব বুথ। কিন্তু সেতুটি দুই লেন হওয়ায় যানজট তো কমেইনি, উল্টো যান চলাচলে সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা।
গতকাল নারায়ণগঞ্জের মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায় শত শত গাড়ি যানজটে আটকে থাকতে দেখা যায়। এসব গাড়ি একটু এগোচ্ছে তো পরক্ষণেই থেমে যাচ্ছে। বাসের যাত্রীরা চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে ইতিউতি তাকাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, চার কিলোমিটার দূরে মেঘনা সেতুর টোলপ্লাজা থেকেই শুরু হয়েছে এ জট। এটি এখানকার নিত্যদিনের চিত্র বলে জানালেন দায়িত্বরত হাইওয়ে পুলিশের এক সদস্য। একই অবস্থা সেতুর ওপারেও।
যানচালকরা বলছিলেন, আগে সেতুর ভেতরে যানজট হতো। বুথের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এখন টোলপ্লাজা পার হয়ে সেতুতে ওঠার আগেই দীর্ঘ যানজট তৈরি হচ্ছে। যানজট দীর্ঘায়িত হয়ে ১০-১২ কিলোমিটার পর্যন্তও ছড়িয়ে পড়ছে কখনো কখনো।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী গ্রীনলাইন পরিবহনের চালক মোফাজ্জল হোসেন জানান, সেতু পর্যন্ত আসতে চার-পাঁচ কিলোমিটার যানজটে প্রায় ১ ঘণ্টা বাড়তি সময় লেগে যায়। আবার সেতুর ওপরে উঠেও কমবেশি ৩০ মিনিট আটকে থাকতে হয়। এ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে প্রায় নিত্যদিনই।
মহাসড়কের আরেক সেতু মেঘনা-গোমতীরও একই অবস্থা। দুই লেনের এ সেতুর দুপাশেও তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এখানেও টোল আদায়ে বাড়তি সময় লাগার কারণে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যানজটের।
এ দুই সেতুর টোল আদায়ের দায়িত্বে আছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস) লিমিটেড। এর কর্মকর্তারাও বলছেন, দুই লেনের সেতুর কারণে যানজট হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে নতুন সেতু না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
তবে সেতুতে টোল আদায়ে অনিয়মের কারণেও যানজট পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করছে বলে অভিযোগ হাইওয়ে পুলিশের। গতকাল দুপুরে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তার যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী রেজা। যানজটের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে যানজট তৈরি হচ্ছে মূলত মেঘনা সেতুর কারণে। সেতু থেকে শুরু করে চার কিলোমিটার দূরে এসে ঠেকেছে গাড়ির জটলা। সেতুতে টোল আদায়ে ধীরগতির কারণে যানজট পরিস্থিতি তীব্র হয়ে উঠছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাঁচপুর হাইওয়ে পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, সেতুর টোলপ্লাজায় অনিয়মের কারণেই যানজট তীব্র আকার ধারণ করছে। ওজন স্কেলে অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহন থেকে অবৈধভাবে টাকা আদায় করা হচ্ছে। যেসব যানবাহনের চালক অবৈধভাবে টাকা দিতে আপত্তি জানাচ্ছেন, তাদের দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা হচ্ছে। আটকে থাকা এসব যানবাহনের পেছনে তৈরি হচ্ছে গাড়ির দীর্ঘ সারি।
যদিও টোল আদায়ে অনিয়মের এ অভিযোগ অস্বীকার করেন সিএনএস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (প্রকল্প ব্যবস্থাপনা) মেজর (অব.) জিয়াউল আহসান সারওয়ার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, পুলিশ যখন এ ধরনের অভিযোগ করছে, তখন তারা এসে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। যথাযথ নিয়ম মেনেই সেতুতে টোল আদায় করা হচ্ছে।
সার্বিক যানজট পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতু দুটি দুই লেনের। সে তুলনায় মহাসড়কে যানবাহনের চাপ অনেক বেশি। এ কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। টোল আদায়ের সময় খুচরা টাকার সমস্যা, চালকদের অসহযোগিতার কারণেও মাঝেমধ্যে আদায়ে ধীরগতি হলে যানজট দেখা দেয়। দ্বিতীয় মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতুর কাজ চলছে। এ সেতু দুটি চালু না হওয়া পর্যন্ত যানজটের দুর্ভোগ মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নির্মিত মেঘনা সেতুটি দুই লেনের। জাপানের অর্থায়নে মেঘনা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হয় ১৯৯১ সালের নভেম্বরে। নাম ‘জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ ১’ হলেও এটি মেঘনা সেতু নামেই বেশি পরিচিত। মহাসড়কটিতেই আছে আরো একটি দুই লেন সেতু, মেঘনা-গোমতী। মহাসড়ক চার লেন হওয়ার পরও দুই লেনের সেতুর কারণে এর সুফল পুরোপুরি মিলছে না।
চার লেনের সুফল পেতে হলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে বলে জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার। তিনি বলেন, হয় টোল আদায় বন্ধ করে দিতে হবে, না হয় এমন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে, যেন টোল আদায়ের কারণে কোনো যানজট তৈরি না হয়। বণিকবার্তা থেকে নেয়া।