কামরুল ইসলাম : স্কুল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের গ্রাম রসুল্লাবাদে থাকে নাহিদা। আগে হেঁটেই প্রতিদিন স্কুলে আসত নাহিদা। খুব কষ্ট হতো, স্কুলে সময়মতো পৌঁছাতেও পারত না কোনো দিন। প্রায়ই স্কুলে অনুপস্থিতও থাকত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শতাব্দী প্রাচীন শ্যামগ্রাম মোহিনী কিশোর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী নাহিদা এখন রোজ স্কুলে আসে। এ বছর স্কুল থেকে একটি বাইসাইকেল পাওয়ায় তার স্কুলে যাতায়াতের কষ্ট লাঘব হয়। নাহিদার মতো ১০০ জন ছাত্রী এখন রোজ বাইসাইকেল নিয়ে বিদ্যালয়ে আসা–যাওয়া করে।
সকাল ৯টা বাজতেই এক এক করে, আবার কখনো দলবেঁধে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরা বাইসাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসতে শুরু করে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে সামাজিক সব বাধা অতিক্রম করে তারা এখন নিয়মিত স্কুলে আসে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শ্যামগ্রাম ইউনিয়নের বেশ কয়টি গ্রামের মেয়েরা নির্বিঘ্নে বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, নারী নির্যাতনকে পরোয়া না করে শ্যামগ্রাম মোহিনী কিশোর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শতাধিক ছাত্রী বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করে। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে, টিফিন পিরিয়ডে বা ছুটির সময় এমন মনোরম দৃশ্য প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে।
শুধু শিক্ষার আলো পেতে প্রতিদিন ২-৫ কিলোমিটার দূর থেকে সাইকেলে যাতায়াত করে মেয়েরা। বিশেষ করে শান্তিপুর, নাছিরাবাদ, নোয়াগ্রাম, শ্রীঘর, রসুল্লাবাদ, বানিয়াচং, কুড়িনালসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে।
১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়ে আজও দক্ষতার সহিত পরিচালিত হচ্ছে। গভর্নিংবডির সভাপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মো. খলিলুর রহমান-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে স্কুল থেকে কলেজে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা দুই হাজারের অধিক। যার মধ্যে বেশিরভাগই মেয়ে শিক্ষার্থী। শিক্ষক রয়েছেন ৩৯ জন।
এক সময় স্কুলে ছাত্রীদের উপস্থিতি বেশ কম ছিল। দূরত্ব আর সামাজিক অবস্থার কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেয়ে নিয়মিত স্কুলে অনুপস্থিত থাকতো। এ পরিস্থিতিকে জয় করতে গভর্নিংবডির সভাপতির উদ্যোগে মেয়েদেরকে বিনামূল্যে বাইসাইকেল প্রদান করা হয়।
জান্নাতুল আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী জানায়, আমার বাড়ি স্কুল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করি। প্রথম প্রথম সমস্যা হতো, কিন্তু এখন কোনো সমস্যা হয় না।
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাহিদা আক্তার জানায়, ‘আগে হেঁটে স্কুলে আসতে অনেক সময় লাগতো। তাই নিয়মিত স্কুলে আসা হতো না। এখন বাইসাইকেল নিয়ে আসার কারণে অনেক সময় বেঁচে যায়। টিফিনের সময় বাড়ি গিয়ে খেয়ে আবার সহজেই স্কুলে আসতে পারি। প্রশাসন তৎপর থাকায় রাস্তা-ঘাটে কেউ উত্যক্ত করার সাহস পায় না।’
পল্লী চিকিৎসক মো. আক্কাছ মিয়া জানান, আমার বাড়ি থেকে স্কুল দূরে হওয়ায় আমার মেয়ের প্রতিদিন ক্লাসে যেতে অসুবিধা হতো। স্কুলে থেকে বিনামূল্যে সাইকেল পাওয়ায় সে নিয়মিত স্কুলে যায়। গ্রামাঞ্চলে মেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায় কিছু লোকের কাছে দৃষ্টিকটু মনে হলেও আমার মেয়েকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেই।
শ্যামগ্রাম মোহিনী কিশোর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোস্তাক আহাম্মদ বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে এখন গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা অনেক এগিয়ে। তারা বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুল কলেজে যাওয়া-আসা করছে। এতে শিক্ষার্থীদের সময় নষ্ট হচ্ছে না। গভর্নিংবডির সভাপতি মহোদয় শিক্ষায় মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করতে ছাত্রীদেরকে বিনামূল্যে সাইকেল প্রদান করেছেন। সাইকেলগুলো সংরক্ষিত রাখার জন্য প্রতিষ্ঠানে স্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সাইকেলে আসা ওদের জন্য সহজ।আমরাও সাইকেলে আসতে ওদের উৎসাহিত করি। কারণ একসঙ্গে দল বেঁধে এলে নিরাপত্তা নিয়ে ভয় থাকে না। ছাত্রীদের আসা-যাওয়ার পথে কেউ আজেবাজে কথা কিংবা কটূক্তি করলে শক্ত হাতে তা নিরসন করা হয়। মেয়েরাও এখন প্রতিবাদ করতে শিখেছে।
প্রতিনিধি/জেএ
আপনার মতামত লিখুন :