সমকাল প্রতিবেদন: ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা– এই তিন ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুর চাপ বেড়েছে রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। শয্যা না থাকায় অনেক শিশুকে ভর্তি না করেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রোগগুলোর উপসর্গ প্রায় একই হওয়ায় বাড়ছে বিভ্রান্তি ও চিকিৎসা জটিলতা।
গতকাল রোববার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগে উপচে পড়া ভিড়। অধিকাংশই জ্বরে আক্রান্ত। শিশুর কান্না আর অভিভাবকের উদ্বিগ্ন মুখে হাসপাতাল চত্বরে এক অন্য রকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
এ বছর এখন পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ৪২৫ শিশু। মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। বর্তমানে ২৫ শয্যার বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নারের একটি সিটও খালি নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ভর্তি হয়েছে আট শিশু। এর মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে শিশুদের জন্য নির্ধারিত বিশেষ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১২ হাজার ৫৫৯ শিশু। মৃত্যু হয়েছে ৩৭ জনের।
এ ছাড়া চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৭ জন এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে ৩৩৫ শিশু হাসপাতালটিতে এ বছর চিকিৎসা নিয়েছে। প্রতিদিন এখানে গড়ে ১১০০ থেকে ১২০০ শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে।
বিভ্রান্ত চিকিৎসক, দুশ্চিন্তায় অভিভাবক
চিকিৎসকরা বলছেন, তিনটি ভাইরাসের উপসর্গ প্রায় অভিন্ন– চার থেকে পাঁচ দিন স্থায়ী উচ্চ জ্বর, মাথা ও শরীর ব্যথা, দুর্বলতা, কখনও হালকা কাশি কিংবা শ্বাসকষ্ট। এ কারণেই রোগ শনাক্তে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে রোগীর চিকিৎসা খরচ বাড়ছে।
শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক এবিএম মাহফুজ হাসান আল মামুন বলেন, চিকুনগুনিয়ার প্রধান লক্ষণ জয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথা, শরীরে র্যাশ ও কয়েক দিন স্থায়ী জ্বর। তবে উপসর্গগুলো ডেঙ্গুর সঙ্গে এতটা মিলে যায় যে, চিকিৎসা শুরুর আগেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুর পরীক্ষা জ্বরের প্রথম পাঁচ দিনের মধ্যে করতে হয়। আর চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে পাঁচ দিন পরে পরীক্ষা করাই ভালো। এর আগে করলে অনেক সময় সঠিকভাবে ধরা পড়ে না। তবে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে করাতে চায় না।
ধারণা করে চিকিৎসা
সাত বছর বয়সী নওশীনকে ভর্তি করা হয়েছিল ডেঙ্গু সন্দেহে। পরে জানা যায়, সে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। তার মা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘মেয়ের জ্বর দেখে ভয় পেয়ে যাই। ডাক্তার বললেন ডেঙ্গু, হাসপাতালে দৌড় দিই। পরে শুনি চিকুনগুনিয়া। আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়।’ রাফি নামে দশ বছরের এক শিশুর বাবা কামরুল হাসানের অভিজ্ঞতাও একই। তিনি বলেন, ‘হাত-পা ব্যথায় কাঁদতে কাঁদতে ছটফট করছিল। ডাক্তার প্রথমে ডেঙ্গু বলেছিলেন, পরে পরীক্ষায় চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে। ভাবিনি এত ভয়ানক হতে পারে।’
চিকিৎসা খরচে হিমশিম পরিবার
ডেঙ্গু কর্নারে ভর্তি এক বছরের শিশু বনী আমিন। তার মা আকলিমা খাতুন বললেন, ‘স্বামী পোশাক কারখানায় কাজ করেন, মাস শেষে যা পান তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। এখন সন্তানের অসুখ, তার চিকিৎসা খরচ কীভাবে সামলাব?’
স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, একই উপসর্গের কারণে এক রোগীকে দুবার পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। একবার ডেঙ্গু, পরে চিকুনগুনিয়ার। এতে চিকিৎসা খরচ যেমন বাড়ে, তেমনি মানসিক চাপও। এখন শুধু স্বাস্থ্য সংকট নয়, এটি জাতীয় অর্থনীতির জন্যও হুমকি।
প্রতি বছর একই বিপর্যয়, নেই স্থায়ী উদ্যোগ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, প্রতিবছর একই ধরনের বিপর্যয় হচ্ছে, তবু সরকারিভাবে এর বিরুদ্ধে কোনো সুসংগঠিত উদ্যোগ নেই। এডিস মশা ব্যবহৃত কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে কিনা, তা অবিলম্বে পরীক্ষা করা উচিত।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে টিকা নিতে হবে। তাহলে সংক্রমণ কমবে। রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় ডেঙ্গুর শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। তবে মশা নিধন না করলে এই হাসপাতলের সব শয্যা ডেঙ্গুর রোগীর চিকিৎসায় দিয়ে দিলেও ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।