মহসিন কবির: সরকার প্রধান বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। প্রথম দিকে সরকার প্রধান আন্দোলনে গুরুত্ব না দিলে পরে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। অবশেষে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সরকার প্রধানরা। কেউ পালিয়েছেন জীবন বাঁচাতে, কেউ গিয়েছেন নির্বাসনে—আর কেউ আর কখনো ফিরতেই পারেননি। ইতিহাসে এমন বহু ঘটনা আছে, যা কেবল রাজনীতির অধ্যায় নয় বরং শাসকের পতনের নির্মম স্মারক হয়ে রয়ে গেছে।
নিচে তুলে ধরা হলো এমনই কিছু রাষ্ট্রপ্রধানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, যারা একদিন ছিলেন ক্ষমতার শীর্ষে—পরদিন নিজ দেশেই জায়গা হয়নি তাদের।
সবশেষ এ বছরের ১১ অক্টোবর মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা: জেন-জি তথা তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভে এবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা। সোমবার বিরোধীদলীয় প্রধান ও অন্য কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এতে বলা হয়েছে, এ নিয়ে এক সপ্তাহে বিশ্বে জেন-জি বিক্ষোভে দুই দেশের সরকারের পতন হয়েছে। সোমবার মাদাগাস্কারের রাজধানী আন্তানানারিভোয় হাজার হাজার বিক্ষোভকারী জড়ো হয়ে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি জানান। এখনই প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে হবে বলে স্লোগান দিতে থাকেন। এর আগে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপালেও তুমুল আন্দোলন করেন জেন-জি প্রজন্ম। তাদের আন্দোলনেও পদ ছাড়তে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি।
মাদাগাস্কারের বিরোধীদলীয় নেতা সিতেনি রান্দ্রিয়ানাসোলোনিয়াই বলেন, সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দিলে রোববার মাদাগাস্কার ছাড়েন প্রেসিডেন্ট। এর আগে প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে বলা হয়, স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন রাজোয়েলিনা। একটি সূত্র জানিয়েছে, রাজোয়েলিনা ফরাসি এক সামরিক বিমানে করে দেশ ছেড়েছেন। ওই সূত্রের দাবি, রোববার ফরাসি আর্মির এক বিমান মাদাগাস্কারের সেইন্ট ম্যারি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর পাঁচ মিনিট পর একটি হেলিকপ্টার রাজোয়েলিনাকে নিয়ে যায়।
ক্যাপসাট নামের সশস্ত্র এলিট ইউনিটের সহায়তায় ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন ক্ষমতাচ্যুত ওই প্রেসিডেন্ট। তবে সম্প্রতি এই বাহিনী তাকে সমর্থন দেয়া বন্ধ করে দেয়। এতে প্রথমে অত্মগোপনে চলে যান রাজোয়েলিনা। এর মধ্যেই তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামেন দেশটির জেন-জিরা। বিক্ষোভ দমনে ক্যাপসাটকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাদের আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছে সশস্ত্র এই বাহিনী। পাশাপাশি দেশের সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগেরও ঘোষণা দিয়েছে তারা।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি: এ বছরের ৯ সেপ্টেম্বর জেন-জিদের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। রাজধানী কাঠমান্ডুতে ব্যাপক সহিংস দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভের দুই দিন পর মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেন কে পি শর্মা অলি। এই বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ১৯ জন নিহত হয়েছে। ‘জেন জেড প্রোটেস্ট’ বা জেন-জি বিক্ষোভ নামে পরিচিত এই আন্দোলনের একটি প্রধান দাবি ছিল ওলির পদত্যাগ।
শেখ হাসিনা (বাংলাদেশ): ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বষৈম্যবরিােধী ছাত্র আন্দােলনরে ‘র্মাচ টু ঢাকা’ র্কমসূচি ঘেির এক গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটলাে আওয়ামী সরকারের। দেশ ছেড়ে পালান প্রধানমন্ত্রী শখে হাসনিা। বকিেেল জাতরি উদ্দেেশ দয়ো ভাষণে অর্র্ন্তবতীকালীন সরকার গঠনরে ঘোষণা দয়িছেনে সনোপ্রধান। অর্র্ন্তবতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ‘শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালায় না’ পালাতে জানে না’—এই কথাগুলো যিনি বারবার বলেছেন, সেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট দুপুরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
গোটাবায়া রাজাপাকশা (শ্রীলঙ্কা): ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকটে সৃষ্ট গণআন্দোলনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান রাজাপাকশা। তিনি প্রথমে সিঙ্গাপুর, পরে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেন। দুই মাস পর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
চার্লস টেলর (লাইবেরিয়া): ২০০৩ সালে গৃহযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে চার্লস টেলর দেশ ছাড়েন। পরে যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ৫০ বছরের সাজা পান। দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে তার বিচার হয়।
থাকসিন শিনাওয়াত (থাইল্যান্ড): ২০০৬ সালে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন থাকসিন। বিদেশে থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পরে লন্ডনে চলে যান এবং সেখানে ১৫ বছর নির্বাসনে ছিলেন। ২০২৩ সালে তিনি দেশে ফেরেন।
নওয়াজ শরিফ (পাকিস্তান): তিনবারের প্রধানমন্ত্রী থাকা নওয়াজ শরীফ ১৯৯৯ সালে সেনা প্রধান মুশাররফের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর সৌদি আরবে নির্বাসনে যান। পরে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৯ সালে লন্ডনে যান এবং ২০২৩ সালে দেশে ফিরে আসেন।
আশরাফ ঘানি (আফগানিস্তান): ২০২১ সালে তালেবানরা রাজধানী কাবুলের দিকে এগিয়ে আসার সময় আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি পালিয়ে যান। পরে জানা যায় তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান নিয়েছেন। নিজ দেশের রক্তপাত এড়াতে তিনি দেশ ছেড়েছেন বলে দাবি করেন।
বেন আলী (তিউনিসিয়া): আরব বসন্তের উত্তাপে ২০১১ সালে ২৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বেন আলীকে তিউনিসিয়া ছাড়তে হয়। তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। সেখানে তার সম্পর্কে খুব কম তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালে জেদ্দার এক হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ (ইউক্রেন): গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও ইউক্রেনে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ পরিচিত ছিলেন রাশিয়াপন্থি হিসেবে। ২০১৪ সালে তার নীতির বিরোধিতায় ইউক্রেনে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। বিক্ষোভকারীরা রাজধানী কিয়েভ দখল করে নিলে পার্লামেন্ট তাকে বরখাস্ত করে। এরপর তিনি পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেন এবং এখনো সেখানেই অবস্থান করছেন।
ফার্দিনান্ড মার্কোস (ফিলিপিন্স): ১৯৮৬ সালে জনবিক্ষোভ ও বিরোধীদের চাপে মার্কোসকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় তিনি গুয়াম দ্বীপে যান এবং পরে হাওয়াইয়ে আশ্রয় নেন। ১৯৮৯ সালে সেখানেই মারা যান।
মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি (ইরান): ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মুখে ১৯৭৯ সালে শাহ পাহলভিকে দেশ ছাড়তে হয়। মিশর, মরক্কো, বাহামা, মেক্সিকো, আমেরিকা হয়ে আবার মিশরে ফিরে যান। ১৯৮০ সালে কায়রোতে তার মৃত্যু হয়।
ইদি আমিন (উগান্ডা): উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিন ১৯৭০-এর দশকে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কুখ্যাত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে জনরোষে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। এর আগে তিনি লিবিয়া ও ইরাকেও অবস্থান করেছিলেন। সৌদিতে লোহিত সাগরের পাশে বিলাসবহুল জীবন কাটান প্রায় দুই দশক। ২০০৩ সালে রিয়াদের এক হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।