হেবাদান (গিফট/দান) করে জমি বা সম্পত্তি কোনো এক সন্তানকে দেয়া হলে পরে তা নিয়ে নানা সাংসারিক সঙ্কট দেখা দিতে পারে—বিশেষত যদি অন্যা-দের (স্ত্রী, অন্যান্য সন্তান) সচেতনতা না থাকে বা হেবাগ্রহী ব্যক্তি অপ্রাসঙ্গিক আচরণ করে। এমন এক সমস্যাজনেরক ঘটনা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই অনেকের কাছেই প্রশ্ন আসে: হেবা দলিল কীভাবে বাতিল করা যায়?
এক অভিজ্ঞ আইনজীবীর বর্ণনা ও সাধারণ আইনী প্রক্রিয়া অনুসারে হেবে দলিল বাতিল করার জন্য যা জানা ও করা প্রয়োজন, তা দেওয়া হল—সতর্কতার সঙ্গে এবং সহজভাবে।
১) হেবা (হবোদান) বৈধ বলার তিনটি শর্ত
কোন হেবা বৈধ পরিপক্ক হিসেবে গণ্য হবে—তার জন্য নিয়মতান্ত্রিক তিনটি শর্ত পূরণ থাকতে হয়:
1. হেবা ঘোষণা (Offer of gift) — দাতা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করবেন যে তিনি তার সম্পত্তি উপহার দিচ্ছেন।
2. গ্রহণ (Acceptance) — যাকে হেবা করা হচ্ছে (গ্রহীতা) তাকে সেই উপহার গ্রহণ করতে হবে। মৌখিক হলে চলবে, তবে ডকুমেন্টারি হলে সুবিধা বেশি।
3. সম্পূর্ণ হস্তান্তর (Delivery/Transfer) — হেবাদাতার জীবদ্দশায় সম্পত্তিটির মালিকানা ও ব্যবহারের সব রেকর্ড (নামজারি, খাজনা, অন্যান্য রেকর্ড) দাতার থেকে গ্রহীতার কাছে সম্পূর্ণরূপে হস্তান্তর করা থাকতে হবে।
যদি এসব শর্ত পূরণ না থাকে—বিশেষত হস্তান্তর না হলে—তাহলে দাতা কিংবা দানের অন্য পক্ষে থাকা উত্তরাধিকারীরা (ওয়ারিশ) আদালতে গিয়ে হেবা বাতিলের দাবি করতে পারবেন।
২) কোন কোন ক্ষেত্রে হেবা বাতিলের সুযোগ থাকে?
বহু বাস্তব ক্ষেত্রে হেবা বাতিলের সুযোগ থাকে। উদাহরণস্বরূপ—
• দাতা সম্পত্তি হস্তান্তর না করলেও কাগজে হেবা করা হয়েছে;
• হেবাগ্রহী ব্যক্তি দায়িত্ব পালন না করছে (যেমন: ভরণ-পোষণ দেওয়া অনুপস্থিত বা মাদকাসক্তি);
• হেবা প্রক্রিয়া জোরজবরদস্তি, ঠকানো বা অসামঞ্জস্যভাবে প্রণীত হয়েছে;
এমন অবস্থায় দাতা বা ক্ষতিগ্রস্ত ওয়ারিশরা আদালতে মামলা করে বাতিল দাবি করতে পারেন।
৩) আইনি প্রক্রিয়া — কীভাবে মামলা করবেন
প্রক্রিয়াটি সাধারণত নিম্নরূপ:
1. প্রাথমিক প্রস্তুতি ও কাগজপত্র সংগ্রহ
• হেবাদান সংক্রান্ত দলিল (হেবা দলিল), সংশ্লিষ্ট দলিল-পত্র, খতিয়ান, রেকর্ড, দলিলদারের কাগজপত্র সংগ্রহ করুন।
• দাতা, গ্রহীতা ও সম্পত্তির সম্পর্ক প্রমাণকারী দলিল যেমন জন্মনিবন্ধন, জেরিকাস ইত্যাদি সংগ্রহে রাখতে হবে।
2. অভিজ্ঞ সিভিল আইনজীবীর সহায়তা নিন
• জমি-বিষয়ক সিভিল মামলার অভিজ্ঞ আইনজীবীকে নিয়োগ করে মামলা তৈরির পরামর্শ নিন।
3. মোকদ্দমা দায়ের (দেওয়ানী আদালতে)
• আইনজীবী সুনির্দিষ্ট বিধি (Specific Relief Act, 1877-এর অনুরূপ বিধি—বক্তার বর্ণনা অনুযায়ী) অনুযায়ী দেওয়ানী আদালতে দলিল বাতিলের মামলা (রিকভারি/অব নালিফিকেশন) দায়ের করবে।
4. জজ বা আদালতের তদন্ত/ফরমাল যাচাই
• বিচারে যদি প্রয়োজন মনে হয়, আদালত তদন্তের জন্য কোনো কর্মকর্তা—ইউনিয়ন/থানা/জেলা অফিসারকে (ইওন/এসিলেন্ট/ওসি)—তদন্তভার দেবে। তদন্ত প্রতিবেদন পেশের পর আদালত সিদ্ধান্ত নেবে।
5. ফলাফল
• প্রমাণ, দলিল ও তদন্ত রিপোর্ট সন্তোষজনক হলে আদালত হেবা দলিল বাতিলের নির্দেশ দিতে পারে। (প্রমাণ অনুপস্থিত বা জোরকদমি থাকলে বাতিল নাও হতে পারে।)
৪) সতর্কতা ও বাস্তব পরামর্শ
• দ্রুত সিদ্ধান্তে হেবাদান করবেন না। বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পরিবার-প্রতিনিধি ও আইনগত পরামর্শ নিন।
• দালাল, স্যান্ডিকেট থেকে দূরে থাকুন। নিজে বা বিশ্বস্ত আইনি পরামর্শে কাজ করুন।
• প্রামাণ্য দলিল রাখুন। হস্তান্তর করলে দলিল, নামজারি, খাজনার রেকর্ড ঠিক রাখুন—এগুলো পরে বড় সহায়ক।
• মানবিক ও ইসলামিক দিকটি বিবেচনা করুন। আইনগতভাবে করা হলেও মানবিক ও ধর্মীয় দিক থেকে পরিবারের মানুষের কল্যাণ বিবেচনা করা শ্রেয়।
• দাতা যদি এখনও জীবিত থাকেন, তবে তিনি নিজেই যদি আবেগ বা ভুল বুঝে সম্পত্তি হস্তান্তর করে থাকেন, তখন দাতা জীবিত অবস্থায় ফেরত নেওয়ার সুযোগ বেশি থাকতে পারে—বিস্তারিত আইনি পরামর্শ আবশ্যক।
৫) সংক্ষিপ্ত উপসংহার
হেবা দলিল বাতিল করা সম্ভব—কিন্তু সেটি নির্ভর করে হেবার প্রকৃততা, হস্তান্তরের পরিমাণ ও দলিলের বৈধতার ওপর। আইনি নথি ও যথার্থ প্রমাণ থাকলে ওয়ারিশ বা দাতা দেওয়ানী আদালতে মামলা দায়ের করে দলিল বাতিল করাতে পারবেন। পক্ষ হিসেবে ধৈর্য, সঠিক কাগজপত্র ও অভিজ্ঞ আইনজীবীর সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।
যিনি এই প্রশ্ন করেছেন—তাঁর মতো পরিবারগুলোর জন্য পরামর্শ থাকবে: প্রথমে অভিজ্ঞ সিভিল আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন, সকল প্রাসঙ্গিক দলিল সংগ্রহ করুন এবং আইনি পথে এগোতে চান কি না তা সংগত রেখে সিদ্ধান্ত নিন। সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ