ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন।। বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সমস্ত কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে গেজেট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু এর আওতায় কী কী থাকবে, তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিভ্রান্তি।
বিশেষ করে সংবাদমাধ্যম এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রে এর প্রভাব কী পড়বে, সেটা বুঝতে পারছেন না অনেকেই।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রকাশ করা ১২ মে তারিখের এই গেজেটে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়ে বলা হয়েছে, "সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ জনমনে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী সংগঠনের ন্যায় বিভিন্ন বেআইনি কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।"
গেজেটে আরো বলা হয়েছে, "...আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্তৃক যে কোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।"
কিন্তু সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে এই গেজেটের বক্তব্য কিভাবে অনুদিত হবে, তা নিয়ে খোদ সাংবাদিকদের অনেকের মধ্যেই রয়েছে বিভ্রান্তি। এ নিয়ে বাংলাদেশের একাধিক গণমাধ্যমের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ডয়চে ভেলে। নামপ্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, এ নিয়ে স্পষ্টতা না থাকায় আওয়ামী লীগের কোনো সংবাদ প্রকাশ বা দলটির কোনো নেতা-কর্মীর মন্তব্যও প্রকাশ না করার ব্যাপারে অনানুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
অবশ্য অনেক সাংবাদিকই জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই তারা দলটির নেতাদের আত্মগোপনে থাকা বা নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের কারণে দলটির কোনো বক্তব্য প্রকাশ করা থাকে বিরত আছ
কয়েকটি জেলায় ঝটিকা মিছিল ছাড়া তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য জমায়েত বা অন্য কোনো কর্মসূচিও দিতে পারেনি দলটি। গত বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যূত হওয়া দলটি এখন কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সক্রিয়।
ফলে এমন এক সময়ে 'কার্যক্রম' এবং 'গণমাধ্যমে প্রচারণা' নিষিদ্ধ বলতে আসলে গেজেটে কী বোঝানো হয়েছে, এ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।
সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মাসুদ কামাল নিয়মিত দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের টক শো-তে অংশ নিয়ে নানা সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন। তার নিজেরও রয়েছে একাধিক ইউটিউব চ্যানেল। ডিডাব্লিউ মাসুদ কামালের কাছে জানতে চেয়েছিল, এই গেজেট প্রকাশের পর তিনি কী বলতে পারবেন, কী বলতে পারবেন না, সেটি তার কাছে স্পষ্ট কিনা।
"আমি যতটা দেখেছি এখনো পরিষ্কার না। কোনটা যে চূড়ান্ত, কার ব্যাখ্যা যে আমরা মানবো, সেটাই তো আমরা বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয়, সরকারের উচিত এ ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা," বলেন তিনি।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)-তে আয়োজিত ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স' অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার বড় একটি কারণ দলটির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ।''
তিনি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ লুট করেছে, খুন-গুম করেছে। সাড়ে তিন হাজার মানুষ গুম হয়েছেন। ধরে নিয়ে আয়নাঘরে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। বাচ্চারাও মুক্তি পায়নি। তারা মানুষের সব অধিকার খর্ব করেছে। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।''
আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সকল দলের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে এবং তারা এটি গ্রহণ করেছে বলেও দাবি করেন প্রেস সচিব।
মানবাধিকার কর্মী ও অন্তর্বর্তী সরকারের গুম কমিশনের সদস্য নূর খান মনে করেন, মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করার ফলে মূলত মানবাধিকারই ক্ষুণ্ণ হলো।
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "কোনো আদর্শকেই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে একেবারে বিনাশ করা যাবে- এটা চিন্তা করা অমূলক। বরং তারা যে অপরাধ করেছে গত ১৬ বছর, সে অপরাধের বিচারের মধ্য দিয়ে তাদের আদর্শ ও চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ ছিল।"
মিছিল-মিটিং-সংবাদ সম্মেলনের মতো রাজপথের কর্মসূচি ছাড়াও অনলাইনে ফেসবুক-এক্স-ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পেজ ও চ্যানেলও বন্ধের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।
নূর খান বলেন, "সর্বক্ষেত্রে কথা বলার অধিকারের ক্ষেত্রে পুরো নিষেধাজ্ঞাটা কোনো না কোনোভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়েই পড়ে, কোনো না কোনো ভাবে।"
মাসুদ কামাল বলেন, "কালকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং যে বিজ্ঞপ্তিটা দিয়েছে, ওই বিজ্ঞপ্তিতে মোটামুটি ক্লিয়ার করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে সরকারের এই সিদ্ধান্তেরও গঠনমূলক সমালোচনা অথবা যৌক্তিক সমালোচনা, এগুলো মিডিয়া অথবা অন্যান্য় দলও করতে পারবে।"
পুলিশের কাছে নির্দেশনা কী?
মঙ্গলবার ঢাকার মিরপুরে মিছিল বের করার চেষ্টার সময় একজনকে আটকের তথ্য ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন পুলিশ প্রধান বাহারুল আলম।
তবে ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই 'আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির স্বার্থে' দেশব্যাপী যৌথ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে অভিযান শুরু করেছিল নিরাপত্তাবাহিনী। অভিযোগ রয়েছে, মূলত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই এই অভিযানে গ্রেপ্তার ও আটক হচ্ছেন।
১২ মে কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের ঘোষণা আসার পরের দুই দিনে কেবল রাজধানী ঢাকা থেকেই আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মমতাজসহ নয় জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় মেট্রোপলিটন পুলিশ।
পুলিশের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে যে, আওয়ামী লীগের পক্ষে কেউ পোস্ট-কমেন্ট করলেও সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কার্যক্রম বা কর্মকাণ্ডের নিষেধাজ্ঞার আওতায় ঠিক কী কী পড়বে? কোন কোন ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে? এসমস্ত বিষয়ে ডয়চে ভেলে জানতে চেয়েছিল পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলমের কাছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কোনো পেইজে কেউ যদি কমেন্ট করে থাকে, তাহলে কি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে? বাহারুল আলম বলেন, "যে কেউ না, অ্যাকটিভিটির ওপর সেটা নির্ভর করবে। যেমন, উনারা অমুক দিবস পালন করলো, কিংবা অমুক দিবস উপলক্ষ্যে বক্তব্য দিলো, অথবা যে-কোনো রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের ওপর বক্তব্য দিলো, এটা তো দলের কার্যক্রমই বোঝায়। এটা নিষেধ, এর মানে উনারা এটা করতে পারবে না।"
দলের পেইজ থাকাটাও একটা কার্যক্রমের মধ্যে পড়ায় সেগুলোও নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে এবং এর ফলে কমেন্ট করারও আর সুযোগ থাকবে না বলে মনে করেন পুলিশ প্রধান।
আওয়ামী লীগের কোনো নেতার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তার বক্তব্য কি প্রচার করতে পারবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম? আইজিপি বলেন, "বলা আছে (প্রজ্ঞাপনে) কার্যক্রম। এটা কি কার্যক্রম প্রকাশ করে? যদি প্রকাশ করে, তাহলে তো এটাও করা যাবে না। এটা দলীয় বিষয়। এটা যদি ব্যক্তিগত বিষয় হয়, যেমন - আপনি ওই জায়গায় জমি দখল করেছেন, এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য দেন, এটা তাহলে কার্যক্রম নয়। কিন্তু তার বক্তব্য যদি দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে হয়, তাহলে তো এটা একভাবে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পড়ে যায়।"
কিন্তু জমি দখলের অভিযোগের বিষয়েও মন্তব্য নিতে গেলে যদি কোনো নেতা এটাকে 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' বলে দাবি করেন, তাহলে সেটা কি প্রকাশ করা যাবে?
এমন নানা প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সাংবাদিকদের মনেও। গণমাধ্যম এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় ঠিক কোনটা করতে পারবে, কোনটা পারবে না, এ বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়ায় মতপ্রকাশের ক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা দিতে পারে।
মাসুদ কামাল উদাহরণস্বরূপ বলেন, "আওয়ামী লীগের কোনো এক নেতা টেলিফোনে একজনের সঙ্গে আলাপ করছে। সেই ফোনকল ফাঁস হলো, যেমন শেখ হাসিনার টেলিফোন কলও ফাঁস হয়েছিল। এটা প্রচারে কি কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে? আমি তো জানি না। ধরেন, সেটা দলীয় কর্মকাণ্ড না, সেখানে দলের নেতাদের প্রতি কিছু বললো না, ইউনূসের শাসনের ব্যাপারে সমালোচনামূলক বক্তব্য দিলো। এটা কি আমি প্রচার করতে পারবো? আওয়ামী লীগের কোনো নেতার ইন্টারভিউ কি আমি প্রচার করতে পারবো? আপনি কি পারবেন?"
এসব বিষয় নিয়ে সরকারের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সাংবাদিক মাসুদ কামাল।
অতীতে কী হয়েছিল?
আওয়ামী লীগ দল হিসাবে নিষিদ্ধ হয়নি, তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে এমন ক্ষেত্রে বক্তব্য প্রচারে নিষিদ্ধ দলের ক্ষেত্রে যেসব বাধা রয়েছে, এক্ষেত্রে তা কেমন হবে সেটাও অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়।
ডিডাব্লিউকে দেয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যরিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, "সন্ত্রাস দমন আইনে কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার কেনো সুযোগ নাই। তাদেরকে নিষিদ্ধ করতে হবে রাজনৈতিক দলকেই।”
এর আগে ২০১৫ সালে 'আইনের দৃষ্টিতে পলাতক' থাকায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুলসহ একটি আদেশ দেয়। তারেক রহমানের কোনো ধরনের বক্তব্য বা বিবৃতি সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমই এরপর থেকে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রকাশ করেনি।
গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর ২২ আগস্ট এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে হাইকোর্ট। এরপর থেকে নিয়মিতই তারেক রহমানের বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশে এখনো নিষিদ্ধ দলের তালিকায় হিজবুত তাহরীরের নাম থাকলেও গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশ্যে 'মার্চ ফর খেলাফত' ঘোষণা দিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে থেকে বের করা মিছিলের সংবাদ এবং পরবর্তীতে তাদের নেতার বক্তব্যও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।