গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকার পতনের পর থেকেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে শেখ হাসিনার ভাষণকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধকরণের দাবি জোরালো হয়। বিশেষ করে এনসিপি নেতারা প্রতিদিনই নিষিদ্ধের দাবি তুলছেন।
তবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হলে বেশ কিছু আইনি জটিলতা ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও পড়তে হতে পারে সরকারকে। এজন্য সরকার ধীরে এগুচ্ছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।
গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদে জড়িতদের বিচার ভোটের আগে দৃশ্যমান দেখতে চায় বিএনপি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত যা বলা হয়েছে সেটি হলো- জনগণ নির্ধারণ করবে কোন দল থাকবে কি থাকবে না। জনগণকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
গণহত্যার বিচার ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিষয়ে শনিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বিএনপি গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেছে। যারা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। তবে আমরা এই কথা বলে আসছি যে, কোন পার্টি নিষিদ্ধ হবে, কোন পার্টি কাজ করবে, কোন পার্টি কাজ করবে না-সেসব বিষয়ে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। জনগণের কাছ থেকে এ সিদ্ধান্ত আসতে হবে।’
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে রাস্তায় নামতে হচ্ছে, যা দেশের মানুষের সামষ্টিক ব্যর্থতা বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এসময় দেশের জনগণের প্রতি নাহিদ ইসলাম আহ্বান জানিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ এখন আর কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি ফ্যাসিস্ট দলে পরিণত হয়েছে। দলটির নিবন্ধন বাতিল করে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে।
আগামী ৩৬ জুলাইয়ের (৫ আগস্ট) আগেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্লাটফর্ম নিয়ে গঠিত ‘জুলাই ঐক্য’-এর নেতারা। বুধবার (৭ মে) বিকেল ৪টায় রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চেয়ে আয়োজিত এক মানববন্ধনে তারা এ দাবি জানান। এ সময় তারা আওয়ামী লীগ প্রধান ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসি এবং আওয়ামী লীগের বিচার চেয়ে একাধিক স্লোগান দেন।
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করাটা সরকারের সদিচ্ছার অভাব, গাফিলতি এবং চরম মাত্রার দূর্বলতার নামান্তর। কেউ কেউ বলছেন, উপদেষ্টাদের মধ্যে কারও কারও আওয়ামীপ্রীতি বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দোসরদের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া কারও কারও মতে কয়েকটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও এজেন্সি থেকে চাপের ভয়ে সরকারের পিছুটানের কারণে নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়া থমকে আছে।
আইনজীবীরা বলছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগটিই যথেষ্ট। সরকার চাইলে ছাত্র-জনতার চাহিদার আলোকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলে বা বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষিদ্ধ করতে পারে। রাজনীতি বিশ্লেষকরাও বিচারের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ জানাচ্ছেন।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা তাদের নেই। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার করা হবে। গত ২০ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি তাদের সঙ্গে বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে দলের যেসব নেতার বিরুদ্ধে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বাংলাদেশের আদালতে বিচার করা হবে।
গত ২ মে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও শেখ হাসিনার বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। এ সময় সংগঠনটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনগণ রায় দিয়ে দিয়েছে। লীগ নিষিদ্ধের দাবি ও জুলাইয়ের এক দফা দাবি একই। নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকবে।
গত ৩ মে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণসহ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১২ দফা দাবি জানানো হয়।
সবশেষ, গত ৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে ‘জুলাই ঐক্য’ নামে এক প্লাটফর্মের (জোট) আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ জোটে আপ বাংলাদেশ, ইনকিলাব মঞ্চ, জুলাই রেভলুশনারি জার্নালিস্ট অ্যালায়েন্স, বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ, এন্টি ফ্যাসিস্ট কোয়ালিশন, রক্তিম জুলাই, সোচ্চার ঢাবি, নিরাপদ বাংলাদেশ চাই, একতার বাংলাদেশ, হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি, জুলাই বিগ্রেড, স্টুডেন্ট রাইটস ওয়াচসহ মোট ৩৫টি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন যুক্ত হয়। আত্মপ্রকাশের দিন প্লাটফর্মটির পক্ষ থেকে বলা হয়, জুলাই বিপ্লবের ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও আমরা দেখছি, গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার প্রক্রিয়া এখনো অনিশ্চিত। বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বেসরকারি মহলের কিছু অংশ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পাঁয়তারা চালাচ্ছে, যা একদিকে শহীদ, আহত ও পঙ্গু জনগণের আত্মত্যাগের চূড়ান্ত অপমান।
জুলাই ঐক্য জোটের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ঢাবি শিক্ষার্থী এবি যুবাইর বলেন, সরকার রাখাইনের জন্য করিডোর দেওয়ার ব্যাপারে কারও কাছে জিজ্ঞেস করেনি, এটাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ যেটি সবার প্রাণের দাবি সেটিই সদিচ্ছার অভারের কারণে এ সরকার করতে পারেনি। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এজেন্সির কারণেও হয়তো সরকার চায় না, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক। তা ছাড়া উপদেষ্টামণ্ডলীদের মধ্যকার কেউ কেউ আছেন, যারা আওয়ামী লীগের প্রতি নমনীয় এবং তাদের একধরনের সুশীল বলতে পারি।
জোটটির আরেক উদ্যোক্তা মুসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ বলেন, বিভিন্ন অ্যাম্বাসি চাচ্ছে না যে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক। এ জন্য উপদেষ্টারাও হয়তো চান না যে তাদের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি খারাপ হোক। অ্যাম্বাসিগুলোর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তারা কোনো রকম মুলা ঝুলিয়ে সটকে পড়তে চাচ্ছেন। তা ছাড়া, ফান্ড বন্ধ হওয়ার ভয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলেরও অনাগ্রহ রয়েছে। কিন্তু আমরা তা হতে দেব না। জুলাই ও শাপলা গণহত্যা, ৫৭ আর্মি অফিসার হত্যাসহ আমরা সব হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে বাধ্য করব।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির গণমাধ্যমকে বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়নি। আওয়ামী লীগের বিচারের জন্য আইনের যে সংশোধনী প্রয়োজন ছিল, সেটাও তারা করেনি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা থাকলে তারা অন্তত বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে পারত। কিন্তু তারা আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে। এটা সরকারের একধরনের কূটকৌশল।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, গণহত্যাকারী ও সন্ত্রাসী দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য বা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল রাজনৈতিক দলগুলো ও শহীদ পরিবার এই বিষয়ে মতামত দিলেও সরকারের কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে না। আমরা সরকারের কাছ থেকে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল ও নিষিদ্ধের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ আশা করছি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, নির্বাচন হলে জনগণ যেভাবে আওয়ামী লীগকে উচ্ছেদ করেছে, সেভাবে জনগণই নিষিদ্ধ করে দেবে। নতুবা সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকারে এখন যারা আছেন, তাদের শিক্ষার্থীরা বসিয়েছে। তাদের উচিত ছিল সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বিষয়টি ফয়সালা করা। তারা এটা না করে বিএনপির নির্বাচন চাওয়ার বিরোধিতা করেছেন এবং আওয়ামী লীগও নিষিদ্ধ হচ্ছে না।
রাজনীতি বিশ্লেষক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী দ্যগণমাধ্যমকে বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা জরুরি কিনা, তা রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দল নিষিদ্ধকরণ একটি চূড়ান্ত পদক্ষেপ, যা সময়সাপেক্ষ এবং জটিল। কোনো দল যখন মানবতাবিরোধী অপরাধ, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে এবং তা প্রমাণিত হয়, তখনই কেবল নিষিদ্ধ করার আইনি ভিত্তি গড়ে উঠতে পারে।
তিনি বলেন, নিষিদ্ধকরণে বর্তমান সরকারের ‘নিষ্ক্রিয়তার’ পেছনে কৌশলগত কারণের পাশাপাশি দলটির স্বাধীনতাযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে দ্রুত নিষিদ্ধের উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এমন সম্ভাবনা কাজ করছে বলেই অনুমান।