মাসুদ কামাল: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৭ জানুয়ারি হওয়ার কথা। যদি সেটা হয়ে যায়, তাহলে একথা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি যে, আপনারা একজন ব্যক্তিকে আগামী সংসদে আর দেখতে পাবেন না। তাকে বিগত বেশ কয়েকটা সংসদে নিয়মিত দেখা গেছে। তিনি জাতীয় রাজনীতিতে যতোটাই গুরুত্বহীন লোক হোন না কেন, তিনি জাতীয় সংসদে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। অন্ততপক্ষে সরকারি দলের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। অনেকসময় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে উনার কর্মকাণ্ড, বক্তব্য হাস্যরসাত্মক লাগলেও সরকার উনাকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি হলেন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের একজন বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্ব এবং জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ। এই রওশন এরশাদকে আগামী জাতীয় সংসদে আর দেখা যাবে না। কেন দেখা যাবে না? কারণ তিনি মনোনয়নপত্রই গ্রহণ করেননি। মনোনয়নপত্র তোলেননি, জমাও দেননি। অতএব তার সংসদ নির্বাচন করারও কোনো সুযোগ নেই।
এই সংসদ নির্বাচনের কথা যখন আলোচনা হচ্ছিলো। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বলেছিলেন, এই নির্বাচনকে তিনি অভিবাধন জানাচ্ছেন। অসাধারণ, আনন্দপূর্ণভাবে একটি নির্বাচন হবে এবং সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করবে। যখন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং মহাসচিবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিলো যে এই এই শর্ত পূরণ না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না তখনও তিনি বলে আসছিলেন তারা নির্বাচন করবেন। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি নির্বাচনে আসলো। যখন জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে আসলো তখন দেখা গেলো রওশন এরশাদের মধ্যে একটি দ্বিধা তিনি নির্বাচন করবেন কিনা। মূল ব্যাপারটি হলো উনার কিছু সহচর আছে যারা উনাকে চালায় তাদের জাতীয় পার্টি বহিষ্কার করেছে। সেই বহিষ্কৃত নেতাদের জাতীয় পার্টি এবার মনোনয়ন দেয়নি। গোস্সা হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা নির্বাচন করবেন না। তারা রওশন এরাশদকে বলেছেন যে, ম্যাডাম বলুনÑ আপনি নির্বাচন করবেন না। আর তিনিও তাই করেছেন। গত বুধবারে তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন এবং সেখানে বলেছেন, ‘আমি দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এবারও তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছি। নির্বাচনে অংশ নিওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।’ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মজিবুল হক সহযোগিতা না করার কারণে দলের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন রওশন। তিনি বলেন, ‘এমন অবস্থায় দলের নেতাদের অবমূল্যায়ন করার কারণে আমার নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ যাদের অবমাননা করা হয়েছে বলে উনি মনে করছেন তারা যেহেতু নির্বাচন করতে পারছেন না। অতএব ম্যাডামও নির্বাচন করবেন না। এই হলো আমাদের বৃদ্ধা ম্যাডামের বক্তব্য।
আমি বলতে চাই তিনি যে ২০১৪ এবং ১৮ সালে নির্বাচনে গিয়েছিলেন সেটা কি আসলে দেশ এবং জনগণের স্বার্থে হয়েছিলো? দেশ এবং গণতন্ত্রের যে রাজনৈতিক ক্ষতিটা হয়েছে তার মূল কারণ ছিলো ওই দুটি নির্বাচনে তার অংশ নেওয়া। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যে মূল ক্ষতিটা হয়েছে তার পেছনে এই দুটি নির্বাচন হওয়া। যার পেছনে রওশর এরশাদেরও ভূমিকা আছে। আবার অন্যভাবে যদি বলি, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আজকে যে দূরবস্থা তার জন্য কারা দায়ী তার যদি একটি তালিকা করি সেই তালিকায় আমি মনে করি দুই থেকে তিন জনের মধ্যে উনার নাম থাকবে। সেই তিনি নির্বাচনে নেই। আমাদের কি কান্না করা উচিত? আমি মনে করি উনি নির্বাচনে নেই, তাতে এই জাতি বেঁচে গেছে এবং আমার মনে হয় এটি জাতীয় পার্টির জন্য একটি বিরাট লাভের ব্যাপার হয়েছে।
২০১৪ সালে উনার স্বামী এরশাদ সাহেব নির্বাচন করতে চাননি। উনি বাধ্য করেছেন এরশাদ সাহেবকে সংসদে আসতে। এরশাদ সাহেব শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন, সবাইকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার জন্য। উনার ভাই জিএম কাদের এরশাদ সাহেবের কথা শুনে তার দাখিলকৃত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারও করে নিয়েছিলেন। যে কারণে সেবার তিনি এমপি হতে পারেননি। এরশাদ সাহেবও ঢাকা থেকে প্রত্যাহার করেছিলেন। কিন্তু লালমনির হাটেরটা রয়ে গিয়েছিলো, সেটা তিনি মুখে বলেছিলেন প্রত্যাহার করেছেন। কিন্তু ...বলেছে প্রত্যাহার হয়নি। উনি নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন এবং তারপর উনি বলেছিলেন যে, আমি শপথ নেবো না। কিন্তু এই ভদ্র মহিলার জন্য উনাকে শপথও নিতে হয়েছিলো। এই এরশাদকে পাশে বসিয়ে রেখে এই ভদ্র মহিলা সংসদে বিরোধী দলের প্রধান হয়ে গিয়েছিলেন। এই হলো রওশন এরশাদের রাজনীতি।
যেখানে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, যেখানে আপোসের রাজনীতি, যেখানে গণতন্ত্রকে ক্ষতি করার রাজনীতি, সেখানেই অবধারিতভাবে বাংলাদেশে রওশন এরশাদের নাম উচ্চারিত হতে থাকবে। এবার উনি নির্বাচন করছেন না অভিমান করে। এটি অভিমান নাকি রাগ বা কার প্রতি রাগ তাতে কিছু যায়-আসে না। কারণ উনার নামই কোথাও থাকবে না। আমি মনে করি, রওশন এরশাদ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র, বাংলাদেশের রাজনীতি একটা বড় অভিশাপ থেকে মুক্ত হলো এই রওশন এরশাদ চলে যাওয়ার পর।
একটা শেষ ইঙ্গিত দিতে চাই, রওশন এরশাদ এখন সমস্ত আলোচনার বাইরে। ২০১৪ সালে উনার কারণে এরশাদ সাহেবকে শেষ পর্যন্ত সংসদে যেতে হয়েছিলো, এরশাদ সাহেব মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার পরেও তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যায়নি উনার কারণে। এবার যদি জাতীয় পার্টি শেষ মুহূর্তে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে চায়, তাহলে রওশন এরশাদ তো নেই, কে বাঁধা দেবেন! সেরকম কিছু কি হতে পারে? সেটা নিয়ে আমরা আরেকদিন আলোচনা করবো। পরিচিতি : সিনিয়রর সাংবাদিক। ‘কথা’ ফেসবুক পেইজের ‘রাজনীতির কথা’ অনুষ্ঠান থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন জান্নাতুল ফেরদৗস