ড. প্রণব কুমার পান্ডে : ক্রমাগত পরিবর্তনশীল ও অস্থির বিশ্বে বাংলাদেশ অধ্যবসায়, উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মডেল। দেশটি অনেক বাধা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দেশটি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবিশ^াস্য কিছু অর্জন করেছে, এর অবস্থান এটিকে বিশ্বব্যাপী একটি কৌশলগত খেলোয়াড় করে তোলছে। একটি বিশৃঙ্খল বৈশ্বিক পরিবেশের মধ্যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাফল্যের পেছনের কারণগুলো এই লেখায় তুলে ধরা হয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। দেশের গড় বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। যা এটিকে বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির একটিতে পরিণত করেছে। একটি শক্তিশালী উৎপাদন খাত, একটি সমৃদ্ধ তৈরি পোশাক শিল্প বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিসহ বেশ কয়েকটি কারণ এই স্থির সম্প্রসারণে অবদান রেখেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রধানত তার নাগরিকদের জীবনযাত্রার উন্নতিতে দেশটির নিষ্ঠার জন্য দায়ী করা যেতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি ব্যয়ের কারণে শিক্ষার হার বাড়ছে, দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাড়ছে। উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত করার সরকারি কর্মসূচির কারণে এখন একটি সমৃদ্ধশালী স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম রয়েছে, যা দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছে।
অনেকেই বাংলাদেশকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সামনের সারিতে একটি রাষ্ট্র হিসেবে দেখেন। দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য বিশেষভাবে সংবেদনশীল কারণ এটি একটি নিম্ন ব-দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থান করে, যা বন্যা ও ঝড়ের কারণে ধ্বংসের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব সমস্যায় নতি স্বীকার না করে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, বন্যা-প্রতিরোধী অবকাঠামো জলবায়ু-প্রতিরোধী কৃষি পদ্ধতির প্রচার শেখ হাসিনার অধীনে সরকারের নেওয়া অভিনব পদ্ধতির কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। নবায়নযোগ্য শক্তি, বিশেষ করে সৌর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে অগ্রগামী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে পারে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অর্থ বিনিয়োগ করে তার বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য নির্ভরযোগ্য বিদ্যুতের নিশ্চয়তা দিতে পারে। কোভিড-১৯ এটিকে লাইনচ্যুত না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি প্রতিশ্রুতিশীল প্রবৃদ্ধির পথে ছিল। ২০২০ সালে দেশটিকে গুরুতর অসুবিধাতে ফেলেছিল। অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও তাদের অর্থনীতি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপর মহামারীর বিধ্বংসী প্রভাব অনুভব করেছিল। রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধের সম্প্রসারণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার আরেকটি তরঙ্গ ডেলিভার করেছে ঠিক যখন বাংলাদেশ কোভিড-১৯ এর বিধ্বংসী পরিণতি থেকে পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ অবিশ্বাস্য সহনশীলতা দেখিয়েছে কোভিড-১৯ মহামারী রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট সহ প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জের মুখে সাফল্যের গল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি অসাধারণ দৃঢ়তার সঙ্গে মহামারী ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা করেছে।
কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় বাংলাদেশের দ্রুত ও কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেশটির প্রস্তুতি ও নেতৃত্বের উদাহরণ। ভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকার ব্যাপক পরীক্ষা, যোগাযোগ, জনসচেতনতামূলক প্রচারণার মতো ব্যাপক ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সামান্য সময় নষ্ট করেছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য লকডাউন সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো ন্যূনতম ব্যাঘাতের সঙ্গে চলতে থাকে। চিকিৎসা গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার শক্তি প্রদর্শন করেছে। সরকার, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, সাধারণ জনগণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার কারণে বাংলাদেশ তার বাসিন্দাদের মহামারী থেকে রক্ষা করতে উদ্যোগী ছিল। কোভিড-১৯ টিকা পাওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী অনুসন্ধানের মধ্যে বাংলাদেশের সফল টিকাকরণ অভিযানটি সফল হয়েছে। বাংলাদেশ অনুন্নত কিন্তু এর ভ্যাকসিন সংগ্রহ, বিতরণ ও প্রশাসন ব্যবস্থা সু-চালিত। বাংলাদেশ তার জনসংখ্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে কারণ অন্যান্য দেশ ভ্যাকসিনের জন্য তাদের হাত পেতে লড়াই করছে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ টিকাদানের সাফল্য জনস্বাস্থ্য ও জনগণের মঙ্গলের প্রতি দেশটির নিবেদনকে প্রতিফলিত করে। এটি সতর্ক পরিকল্পনা, বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতা একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর ফলাফল। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব সত্ত্বেও অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে সরকার দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত খাত, বিশেষ করে টেক্সটাইল ও পোশাকের মতো রপ্তানিমুখী শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য উদ্দীপনামূলক ব্যবস্থা তৈরি করেছে। এছাড়াও হোম সেক্টরে সহায়তা, উদ্ভাবন প্রচার ও অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। মূলত অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগের (এসএমই) প্রচারের উপর দেশটির জোর দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবগুলো প্রশমিত করতে সক্ষম হয়েছে।
রাশিয়া ইউক্রেনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হয়েছিল। তবুও বুদ্ধিমান অর্থনৈতিক নীতি, বিচক্ষণ রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কারণে দেশটি এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে কার্যকরভাবে নেভিগেট করেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হ্রাস সরবরাহ নেটওয়ার্কে বাধার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন দেখিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মূলত দেশের অবিচলিত রেমিট্যান্স ও এফডিআই প্রবাহের জন্য দায়ী। সরকার তহবিল পেতে বিদেশি বাজারে প্রবেশের জন্য আইএফআই-এর সঙ্গে কাজ করেছে। এই কৌশলগত পদক্ষেপ ও উদ্ভাবনী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির কারণে বাংলাদেশ ঝড় থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক প্রভাব বৈশ্বিক মঞ্চে দেশটির আরোহণের ইঙ্গিত দেয়। দেশটি সহযোগিতার প্রচার সমালোচনামূলক উদ্বেগ মোকাবেলার জন্য একটি সক্রিয় পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করেছে। স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার, দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে আসছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্মী অবদানকারী হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে এই মিশনের প্রতি তার নিবেদনের কারণে। বিপুল সমস্যার মুখে দেশটির মানবিক নেতৃত্বের আরেকটি উদাহরণ হলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্য করা।
বর্তমান অস্থিতিশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতির আলোকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠছে : বাংলাদেশ তার অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে কী সক্ষম? আজকের অনিশ্চিত বৈশ্বিক পরিবেশে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। কোভিড-১৯ মহামারী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে উপস্থাপিত অসুবিধা সত্ত্বেও তার নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়েছে। তার কৌশলগত চিন্তা, উদ্যোগ দেশের কল্যাণে নিষ্ঠা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কোভিড-১৯ মহামারী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট সফলভাবে মোকাবেলা করা মাত্র দুটি উদাহরণ যা অর্থনৈতিক সাফল্য জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার পাশাপাশি আজকের অস্থির বিশ্বে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে সংজ্ঞায়িত করে। মহামারীতে বিজ্ঞ অর্থনৈতিক নীতির তাৎক্ষডুশ সফল প্রতিক্রিয়ার কারণে দেশটি প্রতিকূলতার মুখে স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে। এটি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রতিকূলতার মধ্যেও দৃঢ়তা, পরিকল্পনায় দূরদর্শিতা সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কী কী অর্জন করা যায় তার উদাহরণ বাংলাদেশ।
লেখক : অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র : ডেইলি সান। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ