আহসান হাবিব: [১] মার্ক্সবাদ সামান্য যতটুকু বুঝি, এর সঙ্গে বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে তা বোঝার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার ফল হিসেবে আমার যা প্রত্যয় তাহলো মার্ক্সবাদকে এড়িয়ে এ যাবৎ মানবমুক্তির যা কিছু মতবাদ কিংবা পথের কথা এসেছে, তা প্রকান্তরে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকেই টিকিয়ে রাখার এক একটি ছল মাত্র। কেন? কারণ মার্ক্সবাদের মতো কোনোটাই বিজ্ঞান হয়ে ওঠেনি। আর যা বিজ্ঞান নয়, তা কোনো ফলাফল বয়ে আনে না। বিজ্ঞানের কাজ সত্যটাকে দেখিয়ে দেওয়া।
মার্ক্সবাদ সমাজের গতিকে বিচার করেছে বিজ্ঞানের পদ্ধতি দিয়ে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রাণভোমরা পণ্যকে বিচার করতে গিয়ে এর সঙ্গে জড়িত যা কিছু তার ব্যাখ্যা দিয়েছে বৈজ্ঞানিক মানে। ফলে তা হয়ে উঠেছে সবকিছু নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্য। এখানে যে বিরোধিতা তা বস্তুগত সত্যের দিক থেকে নয়, রাজনৈতিক দিক থেকে। শ্রেণির বিচারে বিষয়টি সংগ্রামকে চিহ্নিত করে ও তার ফলাফল বা মীমাংসা মার্ক্সবাদ যা ঘোষণা করে, তার বাইরে যাবার কোনো পথ নেই।
মানবতাবাদ বা উদারতাবাদ নামের মতবাদগুলো আসলে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখারই বিকল্প কৌশল। সাম্যের শ্লোগান দিয়ে ফরাসি বিপ্লব কিংবা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বুর্জোয়াদের সুবিধা ছাড়া আর কিছু হয়নি। হয়নি কথাটা ভুল, হয়েছে ওই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শ্রেণি হিসেবে সংগঠিত হবার সুযোগ যা অবধারিত। চারপাশে যতো আলোচনা শুনি মনে হয় মার্ক্সবাদী চিন্তার স্থিতিস্থাপকতার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কার্যকর কোনো বিকল্প পন্থা আবিষ্কার করতে পারছে না। ফলে আর্থ-সামাজিক রূপান্তর ঘটছে না, শোষণ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠছে।
[২] কেন মার্ক্সবাদ অলঙ্ঘ্য? কারণ আগেই বলেছি এর বৈজ্ঞানিকতা। যা বৈজ্ঞানিক তা বস্তুগত সত্যের ফল। সামাজিকসত্তার ইতিহাসও সেই সাক্ষ্য দেয়। পুঁজিবাদে যখন দুটি শ্রেণি মুখোমুখি হয়, সহাবস্থান করে, তখন যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তা বিরোধাত্মক। এই বিরোধাত্মক ভূমিকাই দ্বন্দ্ব জারি রাখে, যা মীমাংসার দিকে নিয়ে যায়। যে সমাজ টিকে থাকে দুই পরস্পর বিপরীত বৈশিষ্ট্যের সত্তা নিয়ে, তাই পরিবর্তনের সবকিছু শর্ত এই দুই শ্রেণিকেই ঘিরে আবর্তিত হয়। সমাজে আর যারা আছে তারা এদের যে কোনো একটির সহায়ক বা বিরোধী বলয়ে নিজেদের শক্তি যুক্ত করে। কিন্তু রূপান্তর ঐ দুই শ্রেণিকে ঘিরেই ঘটবে। এর বাইরে যাবার কোনো উপায় নেই।
উৎপাদনের উপায় যাদের হাতে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে তারাই। পুঁজিবাদী সমাজ পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই ব্যবস্থার সুবিধাভোগী অংশ তাই তারাই। এই সুবিধাবাদের যাবতীয় ব্যবস্থা এর নিয়ম দ্বারাই চালিত। ফলে যদি ভাঙতে হয়, তাহলে যে শ্রেণি সরাসরি বঞ্চিত তাদের দ্বারাই ভাঙার কাজটি হতে হবে। এর কোনো বিকল্প হতে পারে না। মার্ক্সবাদের বৈজ্ঞানিকতার শ্রেষ্ঠ দিক হলো মার্ক্সবাদ মানুষের সমাজ নিয়ে আলোচনা করে, কারো ধর্ম বা বর্ণ নিয়ে নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাই বিশ্বজনীন। বিজ্ঞানের কাজই হলো বস্তুসাপেক্ষ। আরোপিত কোনোকিছুই এর আলোচ্য বিষয় নয়। অনেকে ধর্মের ভিত্তিতে মানবমুক্তির কথা বলে। এই দৃষ্টিভঙ্গি সেকেলে এবং অবস্তুগত। ফলে এটা সমস্যা জিইয়ে রাখে এবং মূল সমস্যাকে আড়ালে নিয়ে নিজেদের বদমতলব হাসিল করতে থাকে। [৩] আমার মত হচ্ছে, মার্ক্সবাদ ছাড়া সমাজবদলের আর কোনো শ্রেষ্ঠ মতবাদ নেই, আসেনি।
লেখক: ঔপন্যাসিক