ইমতিয়াজ মাহমুদ: কাজী সালাহউদ্দিনএর ডাকনাম তুর্য। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হয় তুর্য তখন সতের কি আঠারো বছর বয়সী একজন কিশোর। শাহিন স্কুলে ইন্টারমিডিয়েট পড়ে বা মাত্র হয়তো পাশ করেছে। ঢাকার মাঠে অসাধারণ প্রতিভাবান কিশোর ফুটবলার হিসাবে ততদিনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে কিশোর তুর্য- খেলে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। একইসাথে ক্রিকেটও খেলত এই কিশোর ঢাকার প্রথম বিভাগে আজাদ বয়েজের হয়ে। পরে সার্বক্ষণিক ফুটবল খেলোয়াড় হবে বলে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিয়েছে। সেই সময় প্রাদেশিক দলের হয়েও খেলেছে তুর্য। এমন সময় শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ।
সালাহউদ্দিন ঢাকার একটি স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। যুদ্ধ শুরু হবার পর পরিবার থেকে আয়োজন করা হলো, ছেলেটাকে যুদ্ধ বিগ্রহ এইসব থেকে দূরে লন্ডন পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তুর্য লন্ডন যাবে না। যুদ্ধ ছেড়ে পালাবে না, পালাবে না সে তার দেশকে বিপন্ন অবস্থায় রেখে। যুদ্ধে যাবে। মার্চেই তুর্য সীমানা পার হয়ে আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখায়, শুরু হয় ট্রেইনিং। আগরতলায় সেময় অন্য যারা ট্রেইনিং নিচ্ছিল ওদের অনেকের নামই আপনারা জানেন। সচ্ছল বিত্তবান ঘরের সুদর্শন কিশোর ছেলেটি সেই কঠিন কঠোর পরিস্থিতিতে দেশের হয়ে যুদ্ধ করবে বলে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। সেইসময় একজন ভারতীয় সাংবাদিক তুর্যকে খুঁজে বের করে- চলো কোলকাতা, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল হচ্ছে সেখানে তোমাকে চাই।
স্বাধীনতা যুদ্ধে সালাহউদ্দিনের অংশ গ্রহণের প্রসঙ্গটা বাদ দিলেও শুদ্ধ ফুটবলার হিসাবেই তিনি আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের স্থানটি দাবী করতে পারেন। আপনি যদি একটু সতর্কতার সাথে তুলনা করেন, তাইলে দেখবেন যে সালাহউদ্দিনের সময় বাংলাদেশ ফুটবল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেটুকু অগ্রসর হতে পেরেছিল তার পর সম্ভবত আর কখনোই আমরা সেই পর্যায়ে যেতে পারিনি। আর দেশের মধ্যে ফুটবলের জনপ্রিয়তা তখন যেখানে ছিল সেটা যে পরে আর থাকেনি সেটা তো আর বলে দেওয়ার কিছু নাই। ঢাকার মাঠে আবাহনী মোহামেডান বা এই দুটির কোন একটি দলের খেলা হবে আর স্টেডিয়ামে গ্যালারী শূন্য থাকবে সেটা তো তখন কল্পনাও করা যেত না।
সালাহউদ্দিনের কথাতেই থাকি। স্বাধীনতার এক বছর পর সালাহউদ্দিন যোগ দেন আবাহনী ক্লাবে। সেই থেকে ক্লাবের হয়ে এবং জাতীয় দলের হয়ে একের পর এক গোল করে গেছেন তিনি। একসময় লেফট উইংএ খেলা চুন্নুর সাথে একটা জুটি হয় সালাহউদ্দিনের। সালাহউদ্দিনের নিজের ভাষায়, তিনি মাঠে যদি চুন্নুর পায়ে বল থাকতো, তিনি কোনদিকে না তাকিয়েই আক্রমণে সামনে উঠে যেতেন। তিনি জানতেন সময়মতো ঠিকই চুন্নু সেখানে বল পাঠাবেন। কথা বলতে হতো না, ইশারা ইঙ্গিত করতে হতো না, দুজন দুজনকে জানতেন।
১৯৭৫ সনে সালাহউদ্দিনকে খেলতে নিয়ে যায় হংকং প্রথম বিভাগের লীগের ক্যারোলিন হিলস ক্লাব। সেসময় বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান এইসব কোন দেশে তো নয়ই, হংকং ছাড়া এশিয়ার অন্য কোন দেশেই প্রফেশনাল ফুটবল বা প্রফেশনাল লীগ ছিল না। সালাহউদ্দিন ছিলেন প্রথম খেলোয়াড় যিনি বাংলাদেশ থেকে একটা প্রপার আন্তর্জাতিক প্রফেশনাল লীগ খেলতে গিয়েছেন। অনেক পরে বাংলাদেশ থেকে কোলকাতায় সেখানকার ক্লাবের হয়ে ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল আমাদের মুন্না কায়সার হামিদ এরা। সেগুলি ঠিক তুল্য কিনা জানিনা, আমার জানা মতে সালাহউদ্দিনের হংকং খেলতে যাওয়াটাই বাংলাদেশের কোন খেলোয়াড়ের আন্তর্জাতিক পেশাদার ফুটবলে অংশ নেওয়া।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে বড় তারকা এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্লামারাস তারকা ছিলেন সালাহউদ্দিন। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে সালাহউদ্দিনের যত পোস্টার আর কার্ড বিক্রি হয়েছে আর কোন খেলোয়াড়েরই সেটা হয়নি। ওঁর গোলের রেকর্ড ভেঙেছে, ওঁর চেয়ে দীর্ঘ সময় ফুটবল খেলেছে অনেকে, কিন্তু গ্লামার ওঁ জনপ্রিয়তার সেই জায়গাটি থেকে সালাহউদ্দিনকে কেউ টলাতে পেরেছে বলে আমি মনে করি না। সালাহউদ্দিন খেল থেকে অবসরের বহু বছর পর সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সাকিব আল হাসান সেইরকম জনপ্রিয়তার কাছাকাছি হয়তো গেছে, কিন্তু ঐ যে তারকাসুলভ aura (এটার বাংলা কি হবে?) সেটা সালাহউদ্দিনের কাছাকাছি কখনো কারো ছিল না।
না, ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিভা সাফল্য ও আন্তর্জাতিক খ্যাতির দিক দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ক্রীড়াবিদ সম্ভবত সাকিব আল হাসানই। এইটা নিয়ে তর্কের কোন সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু আপনি যখন পঞ্চাশ বছরের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড় হিসাবে ডেকে নিয়ে গিয়ে পুরস্কার দিবেন তখন আসলে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের একজন রথীকে সেরা নম্বর এক আরেকজন মহারথীকে সেরা নং দুই এরকম বলা সম্ভবত ঠিক না। কেননা নানা ক্রীড়ায় দেশের ইতিহাসে নানা সময়ে যারাই মহান একটা স্থান করে নিয়েছেন ওদের কাউকেই আসলে আপনি কারো চেয়ে কম বা ছোট বা প্রথম দ্বিতীয় এইরকম বলা সম্ভবত ঠিক না। এক বছরের জন্যে সেটা করা যায়, কিন্তু একদম দেশের পুরো ইতিহাস নিয়ে এইরকম করা ঠিক না।
সালাহউদ্দিন তো তাই বলে মহামানব নন। তিনি একজন চমৎকার মানুষ। এমনিতে রাজনীতিবিদদের মতো কায়দা করে কথা বলেন না তিনি। কিন্তু ফুটবল নিয়ে যখন যে দায়িত্ব পেয়েছেন সেটা তিনি নিষ্ঠার সাথে আন্তরিকভাবেই পালন করেছেন। ফুটবল তাঁর আবেগের জায়গা। একটা তথ্য আপনাদেরকে জানাতে চাই,
আমাদের নারী ফুটবলের বিকাশে যে ব্যায় হয়, একসময় ফুটবল ফেডারেশনের টাকার সংকট ছিল, সেই ব্যায় নির্বাহ করা যেতো না। সালাহউদ্দিন ব্যক্তিগত অর্থ ব্যায় করেছেন। সম্ভবত সালাম মুরশেদিও টাকা দিয়েছেন। এরা কিন্তু সেটার জন্যে নাম চাননি বা প্রচার চাননি। দেশের ফুটবলটাকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন। পারেননি, ব্যর্থতা তো আছে, অবশ্যই আছে। মহামানব তো এরা নন, কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, সালাহউদ্দিন ফুটবল নিয়ে অসততা করেননি কখনো।
এইসব কথা কেন বলছি। কারণ বাংলাদেশের লোকজন যখন সালাহউদ্দিন সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে সেটা আমাকে ব্যথিত করে। আমি ভেবে পাই না, এটা কি করে সম্ভব যে বাংলাদেশের একজন মানুষ খেলাধুলার কোন একটি ক্ষেত্র সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সালাহউদ্দিন সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য করে? না, সমালোচনা জায়েজ আছে। সমালোচনার সাথে সরেস কৌতুক ধরণের মন্তব্যও ঠিক আছে। কিন্তু কটু কথা, গালাগালি আর সমালোচনা তো এক নয়। আর গালাগালি তো ঠিক কৌতুকের মধ্যেও পড়ে না। বাংলাদেশের মানুষ হয়ে সালাহউদ্দিনকে গালি দেয় কি করে?
বিশ্বকাপ চলার সময় লক্ষ্য করেছি, বিশ্বকাপের আগেও দেখেছি। সাম্প্রতিক পুরস্কার সংক্রান্ত বিবাদের পরেও দেখতে পাচ্ছি সালাহউদ্দিন সম্পর্কে কটু কথা বলছেন অনেকেই। দেখেন, আপনার জাতীয় তারকা যারা- হোক সে সালাহউদ্দিন বা সাকিব আল হাসান বা জোবেরা রহমান লিনু বা অন্য কেউ, ওরা আমাদের হিরো। ওদের নিজেদের প্রতিভা, নিষ্ঠা ও শ্রম এইসব মিলিয়েই ওরা সাফল্য পান বটে কিন্তু কেবল সাফল্যের জন্যে ওরা মানুষের হৃদয়ে নায়কের আসন পান না, সাথে মানুষের ভালোবাসাও থাকতে হয়। সেই ভালোবাসাটা ওরা অর্জন করেছেন। ওদের প্রতি আমরা কথায় কথায় অসম্মান কথা বলবো সেটা তো ঠিক নয়।
একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের এইসব নায়কেরা জীবন যাপন করেন আপনার আমার জন্যেই। ওদের ভুল ভ্রান্তি হতে পারে, ব্যর্থতাও থাকবে। সমালোচনা তো শোভন ভাষায় করা যায়, কঠিন সমালোচনাও করা যায়। মন্দ কথা বলা সেটা এমনিতেও কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর আমাদের নায়কদের সাথে আমরা এইরকম আচরণ কেন করবো?
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট