শিরোনাম
◈ নতুন প্রজ্ঞাপন: বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণও থাকবে কেন্দ্রীয় নজরে ◈ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সারাদেশে ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছিল ◈ ৪৮তম বিশেষ বিসিএস: ২১ চিকিৎসকের সুপারিশ স্থগিত, দুজনের প্রার্থিতা বাতিল ◈ ভারত ও আওয়ামী লীগের দুজেনেরই ক্ষতি হয়েছে, বললেন মির্জা ফখরুল (ভিডিও) ◈ নতুন নির্দেশনা জারি স্কুল-কলেজে কর্মচারী নিয়োগে ◈ গাজীপুরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রাউন্ড স্টেশন বসাচ্ছে স্টারলিংক, ইন্টারনেট সেবা দিতে চায় পার্শ্ববর্তী দেশেও ◈ শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ ঠেকাতে দুই অ্যাপ বন্ধের চিন্তা ◈ সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং ও অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দিল দুদক ◈ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিবিরের জয় রাজনীতিতে নবধারা সৃষ্টি করেছে ◈ জাতীয় বেতন কমিশনের ৪ প্রশ্নমালা, মতামত দেওয়া যাবে অনলাইনে

প্রকাশিত : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৬:২৪ বিকাল
আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১১:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কনটেন্টের নামে নির্যাতন: জোর করে চুল কাটা অপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন

‘আল্লাহ তুই দেহিস’ বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিয়েছিলেন ৮০ বছর বয়সী হালিম উদ্দিন আকন্দ। ময়মনসিংহের তারাকান্দির হালিম উদ্দিনের জোর করে চুল কেটে দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার রেশ না কাটতেই গত শনিবার নাটোরে মাদ্রাসার তিন খাদেমকে মারধর করে চুল কেটে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

মানবাধিকার কর্মী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিডিও তৈরি করে ভাইরাল হওয়া এবং অর্থ আয়ের নেশায় জোর করে চুল কেটে দেওয়া হচ্ছে। জোর করে কারও চুল কেটে দেওয়া কিংবা জীবনযাপনে বাধা সৃষ্টি করা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এটা দেশের সংবিধান ও আইনেরও লঙ্ঘন। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের ভূখণ্ডে

জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য দীর্ঘকাল থেকেই বৈচিত্র্যময়। সেখানে ভালো করার নামে নির্যাতন, অবমাননা ও অপমান করা হচ্ছে। কোনো ব্যক্তি যদি অন্যের ক্ষতি না করে তার পছন্দমতো জীবনযাপন করতে চায় তাহলে তাকে জোর করে পাল্টে দেওয়ার অধিকার অন্য কারও নেই। তাকে মর্মাহত করার অধিকার কারও নেই। এটা স্পষ্ট মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

তিনি আরও বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি মানসিক ভারসাম্যহীন হয় কিংবা বিকারগ্রস্ত হয়, তার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে তাকে পুনর্বাসনের জন্য নিয়ে যেতে পারে। সেটা আমরা মেনে নিই। চুল-দাড়ি কেটে ভিডিও করা এবং নিজের ইচ্ছা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অপরাধ। নিজেকে মহৎ হিসেবে জাহির করার চেষ্টায় এক শ্রেণির লোকজন অন্যের ওপর এমন জোর করছে। সরকারকে এ বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে।

ময়মনসিংহের তারাকান্দার হালিম উদ্দিন ফকিরের চুল জোর করে কেটে দেওয়ার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। প্রায় চার মাস আগের এ ঘটনায় গত শনিবার বিকালে ময়মনসিংহের তারাকান্দা থানায় মামলা হয়েছে। চুল কেটে দেওয়া ব্যক্তিসহ ৭ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ১২ জনকে আসামি করে মামলাটি করেছেন হালিম উদ্দিনের ছেলে মো. শহিদ মিয়া আকন্দ।

ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, যারা চুল কেটেছিল তারা মূলত কনটেন্ট ক্রিয়েটর। থানায় লিখিত অভিযোগ পেয়ে এ ঘটনায় মামলা নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষকে ধরে ধরে চুল কেটে গোসল করানো এবং নতুন জামাকাপড় পরানোর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভালো ভিউ হয়। মানুষ বাহবাও দেয়। আবার অর্থও আয় হয়। এতে নিজেকে মানবিক হিসেবে জাহির করা যায়। তাদের সম্মতির তোয়াক্কা না করেই জবরদস্তি করে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা চুল-দাড়ি কেটে দেন। ফলে সমালোচনা তৈরি হয়েছে। যদি জোর না করে উভয়পক্ষের সম্মতি থাকত, অর্থাৎ ভালোভাবে বুঝিয়ে অযাচিত চুল-দাড়ি কেটে জামাকাপড় এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়া হতো তাহলে বিষয়টি সাধুবাদ পেত।

বাংলাদেশ জাতীয় খতিব পরিষদের সভাপতি মুফতি মাসউদুর রহমান গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, জোরজবরদস্তি ইসলামের সংস্কৃতি না। স্স্থু ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য একজন মানুষকে বোঝাতে হবে। তারপর তাকে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসতে হবে। যাতে ইসলামের সৌন্দর্যও ফুটে ওঠে। তবে যদি মাথায় জটা তৈরি করে নিজেকে বিশেষ ক্ষমতার বলে কেউ জাহির করে এবং মানুষ সেটা বিশ^াসের মাধ্যমে শিরক করে, তাহলে ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ প্রতিটি নাগরিককে আইনের আশ্রয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার দিয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩২ জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে এবং অনুচ্ছেদ ৩৫ কারও প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ নিষিদ্ধ করেছে। প্রকাশ্যে জোর করে চুল কেটে দেওয়া কেবল ভুক্তভোগীর মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার লংঘন। এটা মানুষের মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত। এ ধরনের ঘটনা সমাজে ভীতি, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, জোর করে চুল কেটে দেওয়া আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থি। তাই দায়ীদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যে, ভবিষ্যতে আর কোনো নাগরিক এমন অবমাননা ও বেআইনি আচরণের শিকার না হন।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, কেবল সাধক, ফকির বা সন্ন্যাসীদের চুল কেটে দেওয়া আদর্শিক জায়গা থেকে কারও এখতিয়ারে নেই। সংবিধান হস্তক্ষেপ করার এই এখতিয়ার কাউকে দেয়নি। আমি চুল লম্বা রাখব না ছোট রাখব, না আদৌ রাখব না, সেটা তো আমার সিদ্ধান্ত। এখানে রাষ্ট্রেরও হাত দেওয়ার সুযোগ নেই।

‘মাহবুব ক্রিয়েশন ফোর’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে চুল ও জটা কাটার ভিডিও প্রচার করা হতো। সামাজিক মাধ্যম থেকে আয়ের পাশাপাশি প্রবাসীদের কাছ থেকেও অনুদান নেওয়া হতো। সমালোচনার পর এই কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

মাহবুব ক্রিয়েশন ফোরের এসব কাজ মাঝেমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হতো। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে একটি ভিডিও যেখানে জোর করে এক ব্যক্তির জটা কেটে দেওয়া হয় এবং তার হাতের বালা খুলে নেওয়া হয়। জানা যায়, ওই ব্যক্তির নাম লিটন সাধু। তিনি রাজধানীর পোস্তগোলা মহাশ্মশানে লাশ সৎকারের কাজ করেন এবং সদরঘাট এলাকায় ফল বিক্রি করেন। আধ্যাত্মিক ভাবনা থেকে তিনি দীর্ঘদিন চুল-দাড়ি লম্বা রেখেছিলেন। দুই হাতে ছিল ধাতব বালা। মাহবুব ক্রিয়েশন ফোরের উদ্যোক্তা মাহবুবুর রহমান ও তার দল লিটন সাধুর জটা ও চুল-দাড়ি জোর করে কেটে দেন। এ সময় লিটন সাধু প্রাণপণ চেষ্টা করেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। অভিযোগ করা হয়, চুল কেটে দেওয়ার পর তার হাতের প্রায় ৫০ ভরি রুপার বালা লুটে নেওয়া হয়, যার মূল্য আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা।

মাহবুব ক্রিয়েশনের মাহবুবুর রহমান ফেসবুকে বলেছেন, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের নিয়ে আমাদের যে কার্যক্রম পরিচালনা করতাম, সেটা বন্ধ ঘোষণা করলাম। কাজটা আমাদের চোখে ভালো মনে হলেও বেআইনি।

এদিকে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলায় মাদ্রাসার জন্য অনুদান সংগ্রহকারী তিনজন খাদেমকে মারধর করে চুল কেটে দেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে। শনিবার রাতে নলডাঙ্গা থানায় মামলাটি করেন ভুক্তভোগী খাদেম মামুন হোসেন। এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। সূত্র: দৈনিক আমাদের সময় 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়