লিয়াকত হোসেন জনী, মধুপুর (টাঙ্গাইল): তাল একটি অতি প্রাচীন আঁশ যুক্ত রসালো ফল। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ তাল খাদ্য হিসাবে নানা ব্যবহার করে আসছে। তাল গাছ এবং তালপাতার ব্যবহারও দীর্ঘদিনের। তাল আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের গ্রীষ্মকালীন একটি জনপ্রিয় ফল।
তাল ফলের পরিচিতি:
তাল ফল নানা নামে পরিচিত। স্থান ও অবস্থান ভেদে এর নামেরও রয়েছে রকমফের। তাল ফলের ইংরেজি নাম- Palmyra, ice apple, Toddy palm, Borassus flablellifer, Fan palm, Palm- cabbage, Taal, Chunk, Lump প্রভৃতি।
জাত বা শ্রেণি:
তালের কোনো অনুমোদিত জাত বা শ্রেণি নেই। তবে এদেশে বিভিন্ন আকার ও রংয়ের তাল দেখা যায়। আবার কোনো কোনো তাল গাছে কম বেশী বার মাসই তাল ধরে থাকে।
তাল গাছের আদিপান্ত:
তাল গাছ এরিকাসি পরিবারের বরাসুস (Borassus) গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এটি সাধারণত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের গাছ। এই গাছ আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জন্মে থাকে। এটি একটি অতি প্রাচীন গাছ। তালগাছের বৈজ্ঞানিক নাম- Borassus flabellifer. তাল গাছের ইংরেজি Wone palm, doumb Palm, Tala Palm Palmyra Palm, Fan Palm etc. তাল গাছ পাম গোত্রের অন্যতম দীর্ঘ গাছ যা উচ্চতায় ৩০ মিটার থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। তালের পাতা পাখার মত ছড়ানো তাই বোরাসাস গণের পাম গোত্রীয় গাছগুলিকে একত্রে ফ্যান-পাম বলা হয়।
এটি একটি ভিন্নবাসী উদ্ভিদ, পুর্বষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা গাছে উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের সব এলাকায় কমবেশী তাল উৎপাদন হলেও ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, রাজশাহী ও খুলনা এলাকায় সবচেয়ে বেশী উৎপাদন হয়।
খাদ্য ও ভেষজগুণ :
তাল ফল এবং বীজ দুইই বাঙালির খাদ্য। তালের ফলের ঘন নির্যাস থেকে তাল ফুলুরি তৈরি হয়। অপরিপক্ক বা কাঁচা তালের বীজ জনপ্রিয় খাবার। একে তালশাঁস, লেপা বলা হয়ে থাকে। তাল গাছের কাণ্ড থেকে রস সংগ্রহ করা হয় এবং তা থেকে তাল মিছরি তৈরি করা হয়ে থাকে। তাছাড়া তাল গাছ থেকে পাটালি, তাড়ি (একপ্রকার চোলাই মদ) গুড় ইত্যাদি তৈরি হয়। তালে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ও সি, জিংক, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং আয়রন সহ আরো অনেক খনিজ উপাদান। এর সাথে আরো আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও এ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান।
আগস্ট মাস থেকে তাল পাকতে শুরু করে এবং অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাকা তাল পাওয়া যায় । গ্রীষ্মকালে তাল গাছের ফল থেকে আহরিত একপ্রকার মিষ্টি রস পাওয়া যায় । গ্রীষ্মের সময় এটি বাংলার একটি প্রতীকী এবং সুপরিচিত খাবার তালের রস ব্যবহার করে অনেক জনপ্রিয় বাঙালি খাবার, পিঠা পায়েস, তালের বড়া, খির, তাল মিছরি প্রভৃতি তৈরি করা হয়।
তাল ফল ও তাল গাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
তাল ভারতীয় উপমহাদেশীয় অনেক অঞ্চলেরই জনপ্রিয় গাছ কারণ এর প্রায় সব অঙ্গ থেকেই কিছু না কিছু কাজের জিনিস তৈরি হয়, প্রায় কিছুই ফেলা যায় না।তাল পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, পুতুল, হাতপাখা, তালপাতার চাটাই, মাদুর, আঁকার পট, লেখার পুঁথি, কুণ্ডলী, ইত্যাদি বহুবিধ সামগ্রী তৈরি হয়। প্রাচীনকালে তালের কাণ্ড দিয়ে বাড়ি, নৌকা, নৌকা বাড়ি ইত্যাদি তৈরি হতো। বতর্মানে কুটির শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে তাল গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
তথ্য সূত্র: এগ্রিকালচার রিসার্চ সার্ভিস (ARS) ইউনাইটেড স্ট্যাটস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার (USDA), (GRIN), উইকিপিডিয়া।
জীবন-জীবিকা:
জীবন জীবিকার জন্য অনেকেই মৌসুমী ব্যবসায়ী হিসাবে কাঁচা তালের শাঁস বা লেপা বিক্রি করে থাকেন। টাঙ্গাইল, মধুপুরের কুড়ালিয়া ইউনিয়নের কেউটাই গ্রামের মো. ফাইলা মিয়া এবং দরিহাতিল গ্রামের জয়েন উদ্দিন জানান, তারা প্রতিশ তাল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় ক্রয় করেন। এবং প্রতিটি তালের শাঁস ৫ টাকা থেকে ১০ টাকায় বিক্রয় করেন। এতে তারা প্রতিদিন ৯০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা আয় করেন। এতে তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভালো ভাবে জীবন যাপন করতে পারেন। সাম্প্রতিক টাঙ্গাইলের মধুপুরের বিখ্যাত মধুপুর হাট ঘুরে দেখা যায় লোকজন তালের শাঁস ক্রয় করছেন। কেউ কেউ বাসা বাড়ির জন্য তালের শাঁস কিনে নিচ্ছেন। তারা বলেন এই তীব্র তাপদাহে কাঁচা তালের শাঁস বড়দের পাশাপাশি শিশুদের খুবই প্রিয়।
তাল গাছ ও তাল ফল সম্পর্কে মধুপুর (টাঙ্গাইল) উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আল মামুন রাসেল বলেন, তাল একটি সুপরিচিত জনপ্রিয় ফল। তাছাড়া তালগাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। গবেষকদের ধারণা তালগাছ বজ্রপাত নিরোধের কাজ করে। তাই তিনি এবছর মধুপুর উপজেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার পাশে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় তালবীজ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
প্রতিনিধি/এসএ