আমাদের শরীরে প্রায়শই নানা ধরনের দাগ বা তিল দেখা যায়। এর বেশিরভাগই নিরীহ এবং শরীরের স্বাভাবিক অংশ। তবে কিছু দাগ বা পরিবর্তন হতে পারে ত্বকের ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ। চিকিৎসকরা বলছেন, ত্বকের কিছু নির্দিষ্ট পরিবর্তনকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে ত্বকের ক্যান্সার প্রায় শতভাগ নিরাময়যোগ্য।
আসুন জেনে নেওয়া যাক ত্বকের কোন তিনটি পরিবর্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি নির্দেশ করতে পারে।
ত্বকের ক্যান্সারের, বিশেষ করে মেলানোমার, অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো নতুন কোনো তিল বা দাগের আবির্ভাব অথবা পুরোনো তিলের আকৃতি, রঙ বা গঠনে পরিবর্তন আসা। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা সন্দেহজনক তিল বা দাগ শনাক্ত করার জন্য একটি সহজ নিয়ম অনুসরণ করার পরামর্শ দেন, যা "ABCDE Rule" নামে পরিচিত।
A for Asymmetry (অপ্রতিসাম্য): সাধারণ তিল বা দাগগুলো গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির হয়, অর্থাৎ এর দুই অর্ধাংশ দেখতে একই রকম হয়। কিন্তু ক্যান্সারযুক্ত দাগ বা তিল অপ্রতিসম হয়, অর্থাৎ এর এক অর্ধাংশের সাথে অন্য অর্ধাংশের মিল থাকে না।
B for Border (অমসৃণ সীমানা): সাধারণ তিলের সীমানা মসৃণ এবং সুস্পষ্ট হয়। অন্যদিকে, ক্যান্সারযুক্ত দাগের সীমানা অমসৃণ, খাঁজকাটা বা ঝাপসা প্রকৃতির হতে পারে।
C for Color (অস্বাভাবিক রঙ): একটি নিরীহ তিলের রঙ সাধারণত একই রকম (যেমন সম্পূর্ণ বাদামী বা কালো) হয়। কিন্তু ক্যান্সারযুক্ত দাগে বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ দেখা যেতে পারে, যেমন—কালো, বাদামী, ছাই, লাল, সাদা বা নীল রঙের সংমিশ্রণ।
D for Diameter (ব্যাস): যদি কোনো তিল বা দাগের ব্যাস ৬ মিলিমিটারের (পেন্সিলের পেছনের রাবারের সমান) বেশি হয়, তবে তা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। যদিও কিছু ক্যান্সারযুক্ত তিল এর চেয়ে ছোটও হতে পারে।
E for Evolving (পরিবর্তন): যেকোনো তিল বা দাগের আকার, আকৃতি, রঙ বা উচ্চতায় দ্রুত পরিবর্তন আসা একটি বড় সতর্কসংকেত। যদি দাগটি চুলকাতে শুরু করে, ব্যথা হয় বা রক্তপাত হয়, তবে তা আরও উদ্বেগের কারণ।
শরীরের কোনো দাগ, গোটা বা ক্ষতস্থান যদি সামান্য আঘাতেই বা খোঁচা লাগলেই রক্তপাত ঘটায়, তবে তা মারাত্মক লক্ষণ হতে পারে। ক্যান্সার কোষগুলো খুব দ্রুত অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায়, ফলে এর উপরিভাগের ত্বক অত্যন্ত দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। একারণে সামান্য ঘষাতেই সেখান থেকে রক্তপাত হতে পারে।
বিশেষ করে বেসাল সেল কার্সিনোমা (Basal Cell Carcinoma) এবং স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা (Squamous Cell Carcinoma) নামক ত্বকের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এই লক্ষণটি বেশি দেখা যায়। এমন দাগ বা ঘা অনেক সময় ব্যথাহীন হতে পারে এবং কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরেও শুকাতে চায় না। বারবার শুকিয়ে যাওয়ার ভান করে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। এমন লক্ষণ দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সাধারণ তিল বা দাগগুলো নরম হয়। কিন্তু যদি শরীরে এমন কোনো দাগ বা গোটা দেখা দেয় যা স্পর্শ করলে শক্ত অনুভূত হয় এবং এর উপরিভাগ মোমের মতো মসৃণ, মুক্তার মতো চকচকে বা আঁশযুক্ত হয়, তবে তা অবহেলা করা উচিত নয়।
এই ধরনের দাগগুলো সাধারণত গোলাপি, লালচে বা ত্বকের রঙের হতে পারে এবং ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। অনেক সময় এর মাঝে ছোট ছোট রক্তনালীও দেখা যেতে পারে। এটি নোডুলার মেলানোমা (Nodular Melanoma) বা বেসাল সেল কার্সিনোমার মতো ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। এই দাগগুলো খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং অনেক সময় কালচে বর্ণও ধারণ করে।
উপরে উল্লিখিত যেকোনো একটি বা একাধিক লক্ষণ যদি আপনার শরীরে দেখা দেয়, তবে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের (Dermatologist) শরণাপন্ন হন।
স্ব-পরীক্ষা: মাসে অন্তত একবার ভালোভাবে পুরো শরীরের ত্বক পরীক্ষা করুন। পিঠ বা মাথার ত্বকের মতো অদৃশ্য স্থানগুলো দেখার জন্য আয়না বা পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নিন।
চিকিৎসকের পরামর্শ: সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যান। চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে স্কিন বায়োপসি (Skin Biopsy) করার পরামর্শ দিতে পারেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
মনে রাখবেন, ত্বকের ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। তাই সচেতনতাই প্রতিরোধের শ্রেষ্ঠ উপায়।
সূত্র:
The Skin Cancer Foundation, USA: "Early Detection and the ABCDEs of Melanoma"
American Academy of Dermatology (AAD): "How to spot skin cancer"
Mayo Clinic: "Skin Cancer - Symptoms and Causes"
NHS (National Health Service), UK: "Melanoma skin cancer"