বয়সের কাঁটা চল্লিশ বা পঞ্চাশ পেরোলেই বহু পুরুষের মনে স্বাস্থ্য নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো টেস্টোস্টেরন হরমোনের ঘাটতি। টেস্টোস্টেরনকে কেবল যৌনতার প্রতীক ভাবলে ভুল হবে; এটি পুরুষের শারীরিক শক্তি, পেশির গঠন, হাড়ের ঘনত্ব, মানসিক স্থিরতা, স্মৃতিশক্তি এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ন্ত্রণের অন্যতম চাবিকাঠি। বয়স বাড়ার সাথে এর মাত্রা طبيعتগতভাবেই কিছুটা কমে আসে, যা 'অ্যান্ড্রোপজ' (Andropause) নামে পরিচিত। তবে আধুনিক গবেষণা বলছে, জীবনযাত্রায় কিছু পরিকল্পিত পরিবর্তন আনলে পঞ্চাশের পরেও এই গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের স্বাস্থ্যকর মাত্রা ধরে রাখা সম্ভব। আসুন, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এবং বিশেষজ্ঞ মতামতের আলোকে বিস্তারিত জেনে নিই।
কেন এটি কার্যকরী: ব্যায়াম করলে শরীর টেস্টোস্টেরন উৎপাদনে সংকেত পায়। বিশেষ করে যে ব্যায়ামগুলোতে একাধিক বড় পেশি समूह (Muscle Group) একসঙ্গে কাজ করে, সেগুলি বেশি কার্যকর।
ওজনভিত্তিক বা রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং (Weight/Resistance Training): স্কোয়াট, ডেডলিফট, বেঞ্চ প্রেস, ওভারহেড প্রেসের মতো কম্পাউন্ড ব্যায়ামগুলো টেস্টোস্টেরন বাড়াতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। এই ব্যায়ামগুলো শরীরে একটি অ্যানাবলিক (Anabolic) বা গঠনমূলক পরিবেশ তৈরি করে, যা হরমোন উৎপাদনের জন্য আদর্শ। সপ্তাহে অন্তত ৩-৪ দিন ৩০-৪৫ মিনিটের জন্য এই ধরনের ব্যায়াম করার লক্ষ্য রাখুন।
উচ্চ-তীব্রতার ইন্টারভ্যাল ট্রেনিং (HIIT): অল্প সময়ে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ব্যায়াম করা এবং তারপর অল্প বিশ্রাম নিয়ে আবার পুনরাবৃত্তি করা—এটাই হলো HIIT-এর মূলমন্ত্র। যেমন, ৩০ সেকেন্ড দ্রুত দৌড়ানো, এরপর ১ মিনিট ধীরে হাঁটা। এই চক্রটি কয়েকবার করলে শরীর থেকে গ্রোথ হরমোন এবং টেস্টোস্টেরন নিঃসৃত হয়।
সূত্র: Journal of Strength and Conditioning Research এবং European Journal of Applied Physiology-তে প্রকাশিত একাধিক গবেষণায় রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং ও HIIT-এর সাথে টেস্টোস্টেরন বৃদ্ধির সরাসরি সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।
হরমোন তৈরির কারখানা হলো আমাদের শরীর, আর এর কাঁচামাল আসে খাবার থেকে। টেস্টোস্টেরন উৎপাদনে কিছু খনিজ ও ভিটামিন আবশ্যক।
জিংক (Zinc): এই খনিজটি টেস্টোস্টেরন তৈরির প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত। এর অভাবে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। খাদ্যতালিকায় রাখুন ঝিনুক, রেড মিট, কুমড়োর বীজ, ডার্ক চকোলেট, বাদাম এবং বিনস।
ভিটামিন ডি (Vitamin D): এটি শুধু হাড়ের জন্য নয়, এটি একটি স্টেরয়েড হরমোনের মতো কাজ করে। সূর্যের আলো এর প্রধান উৎস। এছাড়া স্যামন মাছ, টুনা মাছ, ডিমের কুসুম এবং ফোর্টিফায়েড দুধে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ভিটামিন ডি-এর মাত্রা বেশি, তাদের টেস্টোস্টেরনের মাত্রাও স্বাভাবিক থাকে।
ম্যাগনেসিয়াম (Magnesium): পালং শাক, বাদাম, ডার্ক চকোলেট এবং অ্যাভোকাডোর মতো খাবারে ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায়। এটি শরীরের ফ্রি টেস্টোস্টেরনের (Free Testosterone) মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট (Healthy Fats): টেস্টোস্টেরন কোলেস্টেরল থেকে তৈরি হয়। তাই খাদ্যতালিকায় অ্যাভোকাডো, অলিভ অয়েল, বাদাম এবং ঘি-এর মতো স্বাস্থ্যকর ফ্যাট থাকা জরুরি।
সূত্র: National Institutes of Health (NIH) এবং Healthline অনুযায়ী, জিংক এবং ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি লো টেস্টোস্টেরনের অন্যতম প্রধান কারণ।
আপনি যখন ঘুমান, আপনার শরীর নিজেকে মেরামত করে এবং হরমোন উৎপাদন করে। টেস্টোস্টেরন উৎপাদনের একটি বড় অংশ ঘটে গভীর ঘুমের সময়।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ: একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এক সপ্তাহ ধরে যারা প্রতিদিন মাত্র ৫ ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন, তাদের টেস্টোস্টেরনের মাত্রা ১০-১৫% পর্যন্ত কমে গেছে। অপর্যাপ্ত ঘুম কর্টিসল (Cortisol) বা স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা টেস্টোস্টেরনের শত্রু। তাই প্রতিদিন রাতে ৭-৯ ঘণ্টা গভীর ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুম নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
সূত্র: Journal of the American Medical Association (JAMA)-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ঘুমের সাথে টেস্টোস্টেরনের এই গভীর সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে।
দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ বা স্ট্রেস শরীরের জন্য বিষের মতো। মানসিক চাপে ভুগলে শরীর কর্টিসল নামক হরমোন তৈরি করে।
কর্টিসল ও টেস্টোস্টেরনের সম্পর্ক: কর্টিসল এবং টেস্টোস্টেরনের সম্পর্ক অনেকটা বিপরীতমুখী। যখন কর্টিসলের মাত্রা বাড়ে, তখন টেস্টোস্টেরনের উৎপাদন কমে যায়। কারণ, শরীর তখন 'সারভাইভাল মোড'-এ চলে যায় এবং প্রজনন বা শক্তি তৈরির মতো প্রক্রিয়াগুলোকে বন্ধ রাখে। তাই মানসিক চাপ কমাতে নিয়মিত মেডিটেশন, ইয়োগা, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, গান শোনা বা প্রকৃতির কাছাকাছি সময় কাটানোর মতো অভ্যাস গড়ে তুলুন।
এই দুটি অভ্যাস টেস্টোস্টেরন তথা সামগ্রিক পুরুষ স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
অ্যালকোহল: অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে এবং শুক্রাশয়ের (Testes) লেডিগ কোষ (Leydig Cells), যা টেস্টোস্টেরন তৈরি করে, সেগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি শরীরে ইস্ট্রোজেনের (মহিলা হরমোন) মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
ধূমপান: ধূমপান রক্তনালীকে সংকুচিত করে, ফলে শুক্রাশয়ে রক্ত সরবরাহ কমে যায়। এর ফলে হরমোন উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং যৌন স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমার অন্যতম প্রধান কারণ।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা: শরীরে, বিশেষ করে পেটের মেদ বা চর্বি কোষ (Fat Cells) অ্যারোমাটেজ (Aromatase) নামক একটি এনজাইম তৈরি করে। এই এনজাইমের কাজ হলো টেস্টোস্টেরনকে ইস্ট্রোজেনে (মহিলা হরমোন) রূপান্তরিত করা। আপনার শরীরে যত বেশি চর্বি থাকবে, এই রূপান্তরের হার তত বাড়বে এবং টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমতে থাকবে। তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমে বডি মাস ইনডেক্স (BMI) স্বাভাবিক মাত্রায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
উপরোক্ত নিয়মগুলো মেনে চলার পরেও যদি ক্লান্তি, যৌন অনীহা, পেশিশক্তি কমে যাওয়া বা অবসাদের মতো লক্ষণগুলো থেকে যায়, তবে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের (এন্ডোক্রিনোলজিস্ট) পরামর্শ নিন।
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হরমোনের মাত্রা নির্ণয় করে চিকিৎসক প্রয়োজন অনুযায়ী টেস্টোস্টেরন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (TRT)-এর পরামর্শ দিতে পারেন। তবে এটি অবশ্যই চিকিৎসকের কঠোর তত্ত্বাবধানে করতে হবে, কারণ এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে।
শেষ কথা:
বয়স বাড়া একটি স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া, কিন্তু এর গতি এবং প্রভাব অনেকটাই আমাদের জীবনযাত্রার উপর নির্ভরশীল। পঞ্চাশ বছর বয়সেও একজন পুরুষ তারুণ্য, শক্তি ও মনোবল ধরে রাখতে পারেন, যদি তিনি নিজের শরীরকে সম্মান করেন এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো দৈনন্দিন জীবনের অংশ করে নেন। বয়সকে একটি সংখ্যা হিসেবে দেখুন এবং সচেতন জীবনযাপনের মাধ্যমে নিজের সুস্থতাকে নিশ্চিত করুন।
সূত্র তালিকা:
Healthline.com: "8 Proven Ways to Increase Testosterone Levels Naturally."
Mayo Clinic: "Testosterone therapy: Potential benefits and risks as you age."
National Institutes of Health (NIH), Office of Dietary Supplements: "Zinc," "Vitamin D."
Journal of the American Medical Association (JAMA): "Effect of 1 Week of Sleep Restriction on Testosterone Levels in Young Healthy Men."
European Journal of Endocrinology: "The role of obesity in the relation between testosterone and insulin resistance."