ত্বকের যত্ন এখন আর কেবল নারীদের বিষয় নয়, পুরুষরাও এ বিষয়ে সমান সচেতন। কিন্তু এত সচেতনতা সত্ত্বেও ব্রণর সমস্যা প্রায় সকলের জন্যই এক সাধারণ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এবং খাদ্যাভ্যাসের মতো একাধিক কারণ এর জন্য দায়ী হলেও, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রায়শই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়—শরীরে ভিটামিনের অভাব। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, নির্দিষ্ট কিছু ভিটামিনের ঘাটতি ত্বকের স্বাস্থ্য নষ্ট করে এবং ব্রণর উপদ্রব বাড়িয়ে দেয়।
ব্রণ এবং ভিটামিনের সম্পর্ক:
ত্বক আমাদের শরীরের সর্ববৃহৎ অঙ্গ এবং এর সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য পুষ্টি অপরিহার্য। যখন শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেয়, তখন ত্বকের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়। এর ফলে সিবাম (ত্বকের প্রাকৃতিক তেল) উৎপাদন বেড়ে যায়, ত্বকের কোষের মৃত্যুহার অনিয়ন্ত্রিত হয় এবং প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা ব্রণ সৃষ্টির মূল কারণ।
কোন কোন ভিটামিনের অভাবে ব্রণ হয়?
১. ভিটামিন এ (Vitamin A):
ত্বকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনগুলির মধ্যে ভিটামিন এ অন্যতম। এটি ত্বকের কোষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও পুনর্গঠনে সাহায্য করে।
অভাবের প্রভাব: শরীরে ভিটামিন এ-এর ঘাটতি হলে ত্বকের উপরিভাগের কোষগুলো শক্ত ও মৃত হয়ে যায়, যা লোমকূপের মুখ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে সিবাম বা তেল ভেতরে জমে থাকে এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের সুযোগ তৈরি হয়। এছাড়াও, ভিটামিন এ-এর অভাবে ত্বক শুষ্ক ও খসখসে হয়ে পড়ে, যা ব্রণর সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
২. ভিটামিন ডি (Vitamin D):
ভিটামিন ডি মূলত হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য পরিচিত হলেও ত্বকের জন্যও এটি অপরিহার্য। এর শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বা প্রদাহরোধী গুণ রয়েছে।
অভাবের প্রভাব: শরীরে ভিটামিন ডি-এর অভাব হলে ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এর ফলে Cutibacterium acnes (ব্রণ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া) সহজেই ত্বকে বাসা বাঁধতে পারে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের মারাত্মক ব্রণর সমস্যা রয়েছে, তাদের অনেকের শরীরেই ভিটামিন ডি-এর মাত্রা প্রয়োজনের চেয়ে কম থাকে।
৩. ভিটামিন ই (Vitamin E):
ভিটামিন ই একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ত্বককে ফ্রি র্যাডিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে।
অভাবের প্রভাব: এই ভিটামিনের ঘাটতি হলে ত্বকের কোষে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ে, যা প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর ফলে ত্বকের ছোট ছোট ছিদ্র বা পোরগুলিতে ময়লা ও ব্যাকটেরিয়া জমে ব্রণর জন্ম দেয়। ভিটামিন ই ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতেও সাহায্য করে, যার অভাবে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৪. ভিটামিন বি কমপ্লেক্স (Vitamin B Complex):
ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লাভিন), বি৬ (পাইরিডক্সিন) এবং বি১২-এর মতো ভিটামিনগুলি ত্বকের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
অভাবের প্রভাব: এই ভিটামিনগুলির অভাবে ত্বকের স্বাভাবিক বিপাক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এর ফলে কেবল ব্রণই নয়, ত্বকে হাইপারপিগমেন্টেশন (মেচেতার মতো দাগ), শুষ্কতা এবং লালচে ভাবও দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে, ভিটামিন বি৬ হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে, যার অভাবে ব্রণর সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ:
ব্রণর সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে একটি সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
সুষম আহার: প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় তাজা ফল (যেমন - পেঁপে, আম, কমলালেবু), সবুজ শাকসবজি (যেমন - পালং শাক, গাজর, মিষ্টি আলু), মাছ, ডিম, বাদাম এবং বিভিন্ন ধরনের বীজ (যেমন - সূর্যমুখীর বীজ, ফ্ল্যাক্সসিড) অন্তর্ভুক্ত করুন। এই খাবারগুলি ভিটামিন এ, ডি, ই এবং বি কমপ্লেক্সের প্রাকৃতিক উৎস।
পর্যাপ্ত জল পান: দিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করুন, যা ত্বককে ভেতর থেকে আর্দ্র রাখতে এবং শরীর থেকে টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে।
জীবনযাত্রায় পরিবর্তন: মানসিক চাপ কমানো, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং পর্যাপ্ত ঘুম ব্রণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ:
মনে রাখা প্রয়োজন, ব্রণর পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে, যেমন - পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS), থাইরয়েড বা অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতা। তাই সমস্যা গুরুতর হলে বা ঘরোয়া চিকিৎসায় উন্নতি না হলে নিজে থেকে কোনো ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ না করে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা ডার্মাটোলজিস্টের (ত্বক বিশেষজ্ঞ) পরামর্শ নিন। সঠিক কারণ নির্ণয়ের মাধ্যমে উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করাই হলো সুস্থ ও ব্রণমুক্ত ত্বক পাওয়ার সেরা উপায়।
সূত্র: বিভিন্ন স্বাস্থ্য পত্রিকা, ওয়েবএমডি (WebMD), হেলথলাইন (Healthline) এবং ত্বক বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি সংকলিত।