নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাস্থ্য ডেস্ক: কিডনি আমাদের শরীরের ‘নীরব কর্মী’। প্রতিদিন প্রায় ১৮০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে শরীরকে বিষমুক্ত রাখার মতো কঠিন কাজটি করে এই দুটি ছোট্ট অঙ্গ। কিন্তু আমাদেরই কিছু অসচেতন অভ্যাস এই অক্লান্ত কর্মীর আয়ু নীরবে কেড়ে নিচ্ছে। যখন লক্ষণ প্রকাশ পায়, ততদিনে কিডনির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু সাধারণ অভ্যাস কিডনি বিকলের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই পাঁচটি ভয়ংকর অভ্যাস এবং এর পেছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
শরীরকে সচল রাখতে এবং বিষাক্ত পদার্থ (টক্সিন) বের করে দিতে পানির কোনো বিকল্প নেই। ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন (NKF), ইউএসএ-এর মতে, শরীর যখন ডিহাইড্রেটেড বা পানিশূন্য থাকে, তখন কিডনিকে রক্ত পরিশোধন করতে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করতে হয়। নিয়মিত কম পানি পানের ফলে প্রস্রাব ঘন হয়ে যায়। এতে সোডিয়াম, ইউরিয়া এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ কিডনিতে জমে ক্রিস্টাল বা পাথর তৈরি করতে পারে, যা পরবর্তীতে কিডনির কার্যক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়।
ক্ষতির প্রক্রিয়া: কম পানির কারণে কিডনিতে রক্তপ্রবাহ কমে যায়, যা কিডনির কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে কিডনি ফেইলিওরের ঝুঁকি বাড়ায়।
লবণ কিডনির অন্যতম বড় শত্রু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু চিপস, ফাস্ট ফুড, প্রসেসড খাবার, এবং প্যাকেটজাত স্যুপের মতো খাবারে প্রচুর পরিমাণে লুকানো লবণ থাকে। অতিরিক্ত লবণ শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা বাড়ায়, যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে শরীর পানি ধরে রাখে। এর ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
ক্ষতির প্রক্রিয়া: উচ্চ রক্তচাপ কিডনির ভেতরের সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলোকে (গ্লোমেরুলি) ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এর ফিল্টারিং বা ছাঁকন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। এটি দীর্ঘমেয়াদে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD)-এর অন্যতম প্রধান কারণ।
মাথাব্যথা, গা-ব্যথা বা হালকা জ্বরে অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs) যেমন—আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন ইত্যাদি সেবন করেন। জনস হপকিন্স মেডিসিন (Johns Hopkins Medicine)-এর বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, দীর্ঘ সময় ধরে বা উচ্চ মাত্রায় এই ওষুধগুলো সেবন করলে কিডনিতে রক্ত সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে।
ক্ষতির প্রক্রিয়া: এই ওষুধগুলো কিডনির রক্তনালীকে সংকুচিত করে দেয়। ফলে কিডনি পর্যাপ্ত রক্ত ও অক্সিজেন পায় না, যা অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি বা কিডনির কোষের স্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ধূমপান কেবল ফুসফুসের নয়, কিডনিরও চরম ক্ষতি করে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC), ইউএসএ-এর তথ্যমতে, ধূমপান রক্তনালীগুলোকে শক্ত ও সংকুচিত করে (অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস), যা কিডনিতে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এটি উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায় এবং কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস করে। অন্যদিকে, অ্যালকোহল শরীরকে পানিশূন্য করে এবং লিভারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। লিভারের কার্যকারিতা ব্যাহত হলে কিডনির ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ক্ষতির প্রক্রিয়া: ধূমপান ও অ্যালকোহল একত্রে কিডনির ওপর দ্বিমুখী চাপ তৈরি করে। এটি কিডনির রোগকে দ্রুত খারাপের দিকে নিয়ে যায়, বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে।
কাজের চাপ বা অন্যান্য কারণে অনেকেই সময়মতো প্রস্রাব করেন না। এই অভ্যাসটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘক্ষণ মূত্রথলিতে (Bladder) প্রস্রাব জমে থাকলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া জন্মানোর আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়।
ক্ষতির প্রক্রিয়া: এই ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালী বেয়ে কিডনিতে পৌঁছে মারাত্মক সংক্রমণ (Pyelonephritis) ঘটাতে পারে। বারবার এ ধরনের সংক্রমণ হলে কিডনিতে স্থায়ী ক্ষত তৈরি হতে পারে, যা ধীরে ধীরে কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। এছাড়া, প্রস্রাব আটকে রাখলে কিডনির ওপর বাড়তি চাপ পড়ে, যা হাইড্রোনেফ্রোসিস-এর মতো জটিলতাও তৈরি করতে পারে।
কিডনি একবার বিকল হয়ে গেলে তা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। তাই প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই।
পানি পান: প্রতিদিন কমপক্ষে ২-৩ লিটার (৮-১২ গ্লাস) বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
লবণ কমানো: খাবারে বাড়তি লবণ পরিহার করুন। প্রসেসড ও ফাস্ট ফুডের বদলে প্রাকৃতিক ও তাজা খাবার খান।
ওষুধে সতর্কতা: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ব্যথানাশক বা অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করবেন না।
বর্জনীয় অভ্যাস: ধূমপান ও অ্যালকোহল পুরোপুরি বর্জন করুন।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস: সুষম খাবার গ্রহণ করুন এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
নিয়মিত ব্যায়াম: শারীরিক পরিশ্রম কিডনিকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
প্রস্রাবের বেগ: প্রস্রাবের বেগ এলে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে প্রস্রাব করুন।
নিয়মিত পরীক্ষা: যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা পারিবারিক কিডনি রোগের ইতিহাস আছে, তাদের বছরে অন্তত একবার কিডনি পরীক্ষা (Blood Creatinine এবং Urine R/M/E) করানো উচিত।
আপনার সামান্য সচেতনতাই পারে এই অমূল্য অঙ্গটিকে সুস্থ রাখতে। তাই আজ থেকেই ক্ষতিকর অভ্যাসগুলো ত্যাগ করুন এবং একটি সুস্থ জীবনযাপন করুন।
সূত্র:
ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন (National Kidney Foundation, NKF), USA
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization, WHO)
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (Centers for Disease Control and Prevention, CDC), USA
জনস হপকিন্স মেডিসিন (Johns Hopkins Medicine)
স্বাস্থ্য বিষয়ক জার্নাল ও প্রকাশনা।