‘চিকিৎসক বললেন, আমার ক্যানসার হয়েছে। আমি জানতে পারলাম, আমি ক্যানসারের রোগী। হাসপাতাল থেকে বাসা পর্যন্ত আর কথা বলতে পারিনি।’ গত বছর নিজের আত্মজীবনী ‘রবি পথ’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন আবুল হায়াত। ২০২১ সালে ক্যানসার ধরা পড়ে এই বরেণ্য অভিনেতার। তবে চিকিৎসক, পরিবারের সহায়তা আর নিজের অদম্য মনোবলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এখনো মাসের ১৫ দিন শুটিংয়ে ব্যস্ত থাকেন। চনমনে আবুল হায়াতকে দেখে কে বলবে তাঁর বয়স ৮১! আজ এই অভিনেতার জন্মদিন। ১৯৪৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্ম। এরপর কাটিয়েছেন দীর্ঘ, বৈচিত্র্যময় এক জীবন। জন্মদিন উপলক্ষে জেনে নেওয়া যাক আবুল হায়াতের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
কোমা থেকে ফিরে
ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আগেও একবার গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন আবুল হায়াত। সেটা এতটাই গুরুতর যে কোমায় চলে গিয়েছিলেন! ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে দেশে যখন গণহত্যা শুরু করেছে পাকিস্তানি বাহিনী, আবুল হায়াত তখন হাসপাতালে—কোমায়! ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ কোমায় ছিলেন।
২৯ মার্চ কিছুটা সুস্থ হন। জানতে পারেন, এরই মধ্যে বাবা হয়েছেন, জন্ম হয়েছে তার প্রথম সন্তান বিপাশা হায়াতের। ‘এই লও তোমার বিপাশা,’ ছয় দিন বয়সী নবজাতককে কোলে দিতে দিতে সেদিন বলেছিলেন ফুফুশাশুড়ি। সে দিনটা ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ।
ঘুরে দাঁড়ানো
কঠিন সময়ে মানসিক শক্তি জোগানোর কৃতিত্ব স্ত্রী শিরিন হায়াতে দেন আবুল হায়াত। ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর কীভাবে পরিবার সাহস জুগিয়েছে, সে কথা বলতে গিয়ে আবুল হায়াত বলেন, ‘এই মহিলা (শিরিন হায়াত) সারাক্ষণ আমাকে বলতে লাগল, “আরে কী হয়েছে। এটা কোনো ব্যাপার নাকি। আমরা আছি। চিকিৎসা করাব। যেখানে যা যা লাগে, আমরা করব। তুমি ভালো হয়ে যাবে।” আমার মেয়েরা খবর পেয়েছে। তারাও বিভিন্নভাবে বলেছে, “আব্বু, এটা নিয়ে চিন্তা করো না।” যা–ই হোক, আমার তো মন মানে না। রাতে খাবার খেয়েছি কি খাইনি, জানি না। বিছানায় শুয়ে পড়েছি। অন্ধকারে একা কাঁদছি। হঠাৎ টের পেলাম, উনি পাশে এসে শুয়েছেন। আমি তখনো নিঃশব্দে কাঁদছি। হঠাৎ ওনার একটা হাত আমার গায়ে এসে পড়ল। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। তখন উনি “আল্লাহ তায়ালা এই রোগটা তোমাকে কেন দিল, আমাকে দেখতে পেল না?” বলেই হাউমাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সারাটা জীবন আমার সঙ্গে; আমার দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, আনন্দ—সবকিছুতে সে। আজকে আমি এই যে তিনটা বছর ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছি, শুধু তাঁর কারণে। সে আমার সবচেয়ে বড় সহযোদ্ধা, আমাকে শিখিয়েছে, আই এম আ ফাইটার।’
চাকরি আর অভিনয় নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ততা, আবুল হায়াত সংসারে তেমন মন দিতে পারেননি। সংসার সামলে দুই মেয়েকে ভালোভাবে মানুষ করা, অসুস্থতায় মানসিক শক্তি জোগানো—সবকিছুর কৃতিত্ব প্রিয় শিরিনকে দিলেন আবুল হায়াত।
চলতি বছরের মে মাসে এই প্রতিবেদককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘চার বোনের এক ভাই আমি। প্রচণ্ড আদরে বড় হয়েছি। ফলে আমার মানসিক শক্তি ততটা প্রবল ছিল না। কিন্তু বিয়ের পর শিরিই আমাকে সব ব্যাপারে প্রেরণা জুগিয়েছে। আমার জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই ওর সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া। বিয়ের পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাড়ির সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিল অনায়াসে। একটু ভয় ছিল, এই মধ্যবিত্ত পরিবারে সে মানিয়ে নিতে পারে কি না। দেখা গেল দুই বোন, আর ছোট ভাগনে–ভাগনিও ওর নেওটা হয়ে গেল। সরকারি চাকরি ছাড়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নিয়েছি ওর পরামর্শেই।’
আশিতেও চনমনে
এখনো মাসের অর্ধেক দিন শুটিং করেন আবুল হায়াত। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ছুটে বেড়ান। আশিতে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে দেখলে কী মনে হয়? ‘জীবন সুন্দর’, দুই শব্দে উত্তর দিয়েছিলেন আবুল হায়াত। নিজের বেঁচে থাকার মন্ত্র জানিয়ে তিনি বলতে শুরু করেন, ‘জীবন হলো কাজ করার জায়গা। যে যত কাজ করবে, তার জীবন তত সুন্দর। যে কাজটাকে ভালোবাসেন, সেই কাজটা যদি করে যান, তাহলে আপনার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই। আমি সেটাই করার চেষ্টা করছি। আমার কাজ আমি ভালোবাসি, সে কারণেই হয়তো বেঁচে আছি। সবাই বলে আপনি জীবনে কতটা সুখী? আমি বলব, আমি পুরোপুরি সুখী। আব্বা বলতেন, সব সময় কম চাইবে, তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তোমার চাওয়া পূরণ হবে; হতাশ হবে না। সেটা মানার চেষ্টা করেছি।’ উৎস:প্রথম আলো