সহযোগীদের খবর: বেতন বৃদ্ধিসহ তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। দাবি পূরণ না হলে সামনের বার্ষিক পরীক্ষা বর্জন করে সব বিদ্যালয় শাটডাউনেরও হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। এর আগে ১২ অক্টোবর থেকে টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা। তাদের দাবি জাতীয়করণের। একই চিত্র মাধ্যমিকেও, এমপিওভুক্তির দাবিতে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে রাজধানীতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ডিসেম্বর থেকে কর্মবিরতিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন চার দফা দাবিতে। সূত্র: বণিক বার্তা প্রতিবেদন
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের আন্দোলন, কর্মবিরতি ও শ্রেণীকক্ষে অনিয়মিত উপস্থিতির কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এ সংখ্যাটা প্রায় দুই কোটির মতো। বর্তমানে যারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আছে তাদের বড় অংশের মধ্যেই করোনাকালীন শিখন ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে আবার শিক্ষকদের আন্দোলন ও কর্মবিরতি। এর ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠে মনোযোগ হারাচ্ছে, পিছিয়ে পড়ছে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। অনেকে তাই কোচিং বা অনলাইন ক্লাসের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে। শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে। তবে তার সমাধানের প্রক্রিয়া এমন হওয়া উচিত যাতে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত না হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘শিক্ষকরা আন্দোলনে থাকলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। করোনাকালীন যে শিখন ঘাটতি, এখনো অনেক শিক্ষার্থী সেটি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এরপর অভ্যুত্থানসহ নানা কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সময়ে বন্ধ ছিল। এসব ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নানা দাবিতে শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর পড়েছে। বিশেষত যেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কর্মবিরতিতে ছিলেন সেগুলোর শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক বেশি ক্ষীতগ্রস্ত হয়েছে।’
শিক্ষাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিগত সরকার এ খাতকে একপ্রকার ধ্বংস করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন ড. মো. আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও একই পথে চলছে। সব বিষয়ে কমিশন হলেও শিক্ষায় কোনো কমিশন হয়নি। যদি শুরু থেকেই শিক্ষা সংস্কারে উদ্যোগ নেয়া হতো, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হতো, তাহলে হয়তো চিত্রটা ভিন্ন হতো।’
বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিসংখ্যান ২০২৪ অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৬ লাখ ১৭ হাজার ৯৬২। চলতি শিক্ষাবর্ষেও প্রায় একই সংখ্যক শিক্ষার্থী রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই তাদের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু। তবে শিক্ষকরা আন্দোলনে থাকায় বছরান্তের এ মূল্যায়ন পরীক্ষা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
দশম গ্রেড থেকে নবম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, দ্রুত স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠনসহ চার দাবিতে প্রাথমিকের শিক্ষকরা চলতি বছর মোট তিন দফায় কর্মবিরতিতে গেছেন। প্রথম দফায় তারা কর্মবিরতিতে যান ২৬ মে। দ্বিতীয় দফায় ৯ থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত একই কর্মসূচি পালন করেন। দাবি আদায়ে সর্বশেষ গতকাল থেকে আবারো কর্মবিরতিতে গেছেন। শিক্ষকরা ঘোষণা দিয়েছেন, দাবি পূরণ না হলে তাদের এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এমনকি সরকারের কার্যকর উদ্যোগ দেখা না গেলে পরীক্ষা বর্জনেরও ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন তারা।
জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ অবস্থার জন্য সরকার দায়ী। আমরা শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাই না। আমাদের একজন সহকর্মী আন্দোলনে এসে পুলিশের হামলায় মৃত্যুবরণ করেছেন, দেড় শতাধিক আহত হয়েছেন। এরপরও আমরা সরকারের ওপর আস্থা রেখে অপেক্ষা করেছি। তাদের আশ্বাসে ক্লাসেও ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু ১৩ দিন পার হয়ে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে আমরা আবার কর্মবিরতিতে যেতে বাধ্য হয়েছি।’
প্রাথমিকের পাশাপাশি নানা দাবিতে এ বছর আন্দোলনে দেখা গেছে মাধ্যমিকের শিক্ষকদেরও। দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা এবং কারিগরি—এ তিন ধারার বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৮ দশমিক ৮৯ শতাংশই এমপিওভুক্ত। এ স্তরের মোট শিক্ষার্থী প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ ৩ হাজার ৩১৬ জন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ বা প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থীই এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় অধ্যয়নরত বলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষকদের সংগঠনগুলো জানিয়েছে।
বাড়িভাড়া বৃদ্ধিসহ তিন দফা দাবিতে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা গত ১২ থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত আটদিন কর্মবিরতিতে ছিলেন। তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী জানিয়েছেন, তাদের কর্মবিরতিতে শিক্ষার্থীদের যতটুকু ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৩ অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৮৭ লাখ ৪১ হাজার ৪৮০ এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৮ লাখ ২৬ হাজার ৪৭১। সব মিলিয়ে সাধারণ শিক্ষায় সরকারি প্রাথমিক এবং বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী ২ কোটি ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯১৩ জন। মাদ্রাসা ধারায় ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৬২৭ জন, দাখিল পর্যায়ে শিক্ষার্থী ১৪ লাখ ৯ হাজার ৭৮৪ এবং আলিম পর্যায়ে ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৪১০ জন। দাখিল ও আলিম পর্যায়ের সব প্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। সব মিলিয়ে মাদ্রাসা ধারায় ইবতেদায়ি, দাখিল ও আলিম পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭ লাখ ৭৪ হাজার ৮২১ জন। কারিগরি ধারায় মাধ্যমিকে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৮০৪ এবং উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী আছে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৩৬৭ জন। এসব স্তরের প্রায় প্রতিটিতেই শিক্ষকরা নানা দাবিতে আন্দোলন করায় শিক্ষার্থীরা কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ‘সহকারী শিক্ষক’ পদটিকে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত করাসহ চার দফা দাবি মেনে না নেয়ায় কর্মবিরতিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। আগামী সপ্তাহের শুরু থেকে কর্মবিরতিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি’র শীর্ষ নেতারা। শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৩ অনুযায়ী বর্তমানে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট ৫ লাখ ৭১ হাজার ৬৮১ শিক্ষার্থী।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবিগুলো হলো সহকারী শিক্ষক পদকে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ; এন্ট্রি পদ নবম গ্রেড (ক্যাডার) ধরে চার থেকে ছয় স্তরের পদসোপান প্রবর্তন এবং তার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার গেজেট প্রকাশ করতে হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল নাহিয়ান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শিক্ষকরা দুটি বিষয় সবসময় দাবি করে আসছে। একটি হলো আর্থিক সুবিধা ও মর্যাদা। আমরা নবম গ্রেড পাচ্ছি; আর্থিক সুবিধার দিক নিয়ে আমাদের কোনো কথা নেই। কিন্তু আমরা যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছি না। মর্যাদার প্রশ্নে আমরা চারটি দাবি জানিয়ে আসছি।’
উচ্চ আদালতও তাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘বিভিন্ন জটিলতা দেখিয়ে সরকার তা বাস্তবায়ন করছে না। এতে সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ। বাধ্য হয়ে আমরা বার্ষিক পরীক্ষার মধ্যেই কর্মসূচিতে যাচ্ছি। সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলে আমরা শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাব।’
দেশের প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত উন্নয়নে নয় সদস্যের একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ কমিটির প্রধান ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ। এছাড়া সম্প্রতি মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নেও অধ্যাপক মনজুর আহমদকে প্রধান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি কমিটি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ওপর আন্দোলনের প্রভাবের বিষয়ে অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শিক্ষকরা আন্দোলনে থাকলে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষত পরীক্ষার আগমুহূর্তে বা পরীক্ষার মধ্যে শিক্ষকরা আন্দোলন করলে এর প্রভাব আরো বেশি পড়ে। দেশে শিক্ষায় নানা সংকট রয়েছে, শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধায় ঘাটতি আছে। তাদের দাবিগুলোও অযৌক্তিক নয়। তবে এসব দাবি-দাওয়া আলোচনার মাধ্যমেও সমাধান করা যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা শিক্ষকদের একের পর এক যে আন্দোলনগুলো দেখছি তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে কেউই শিক্ষার্থীদের কথা ভাবছে না এবং মূলত ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরাই হচ্ছে।’
সব সরকারই শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বললেও তা দেয়া হয়নি উল্লেখ করে এ শিক্ষাবিদ বলেন, ‘আসলে কোনো সরকারই শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়নি। ফলে শিক্ষায় সংকট দিনদিন বেড়েছে। বর্তমানে দেশের শিক্ষা খাতে যে সংকটগুলো রয়েছে তা রাতারাতি সমাধান হবে না। আমরা মাধ্যমিকের পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে একটি সভা করেছি। বিভিন্ন জেলায় জেলায়ও অংশীজনদের সঙ্গে সভা করব। সবার মতামত নেব। সবার মতামতের আলোকে এবং সবকিছু পর্যালোচনা করেই আমরা শিক্ষার সংকটগুলোকে শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুপারিশ করব।’