নতুন বিদেশি ঋণ নিতে সরকারি সংস্থাকে মানতে হবে যেসব শর্ত
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যেসব বিদেশি ঋণ বা সহায়তা পেয়েছে, সেসব অর্থ সময়মতো ব্যবহার করতে না পারায় নতুন করে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর জন্য একাধিক পূর্বশর্ত দিয়ে নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করেছে সরকার।
গত সপ্তাহের এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নতুন ঋণের চুক্তি সইয়ের আগে পূর্বশর্ত মানতে হবে। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে—জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা, পুনর্বাসন পরিকল্পনা জমা দেওয়া, উপাদানভিত্তিক খরচের বিস্তারিত হিসাব তৈরি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে দরপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে ৪২ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি সহায়তা পাইপলাইনে থাকলেও, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অংশে ব্যয় হয়েছে এর মাত্র ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট ৮ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা ছাড় করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রকল্প অর্থায়নে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার বা ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বাকি অর্থ ব্যয় হয়েছে উন্নয়ন সহযোগীদের বাজেট সহায়তা হিসেবে।
সাধারণত, এক অর্থবছরে ২০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হলে সেটাকে সন্তোষজনক হিসেবে ধরা হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদেশি সহায়তার অর্থ ব্যবহারে বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই ধীরগতির হলেও, বাজেট সহায়তার ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভালো অগ্রগতি দেখা গেছে।
এর কারণ হলো, বাজেট সহায়তার শর্ত পূরণ ও অনুমোদন পেলেই উন্নয়ন সহযোগীরা দ্রুত অর্থ ছাড় করে দেয়।
গত অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ চারটি বিদেশি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বাজেট সহায়তা হিসেবে ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে অনুমোদনের পরপরই।
কিন্তু পাইপলাইনে বিপুল অংকের অর্থ জমা থাকার পরও সময়মতো ব্যয় করা যায় না। পাইপলাইন হলো—উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণ অনুমোদনের পর যখন সরকার তাদের সঙ্গে চুক্তি করে, তখন তা পাইপলাইনে ব্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে।
সরকারি সংস্থাগুলো সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারলে এর জন্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত কমিটমেন্ট চার্জ দিতে হয় এবং প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়ে যায়।
বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত অধিকাংশ প্রকল্প পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও বছরে ন্যূনতম ২০ শতাংশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করতে পারে না।
এই সমস্যা সমাধানে গত সপ্তাহে ইআরডি বাধ্যতামূলক কিছু শর্ত দিয়েছে। বিদেশি অর্থায়নে প্রকল্পের ঋণচুক্তি সই করার আগে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে এসব শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে, যাতে প্রকল্প শেষ করতে দেরি হওয়া কমানো যায় এবং প্রস্তুতিমূলক কাজের মানোন্নয়ন হয়।
এর মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত হলো—প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে সম্পূর্ণ জমি অধিগ্রহণ শেষ করতে হবে। এমনকি, জমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য একটি পুনর্বাসন পরিকল্পনাও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে।
পাশাপাশি, প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে উপাদানভিত্তিক খরচের বিস্তারিত হিসাব প্রস্তুত করতে হবে এবং দরপত্রের খসড়া জমা দিতে হবে। দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে চুক্তি সই পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া ঋণচুক্তি সইয়ের আগেই শেষ করতে হবে।
ঋণচুক্তি ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সম্পাদিত উপ-চুক্তির শর্তাগুলোর জন্য অর্থ বিভাগ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
একইসঙ্গে, নির্মাণকাজের সময় যেসব ইউটিলিটি বা স্থাপনা স্থানান্তরের প্রয়োজন হতে পারে, সেগুলোর জন্য সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সময়সীমা সম্পর্কিত স্পষ্ট চুক্তি থাকা বাধ্যতামূলক।
বড় ঋণদাতাদের অর্থ ব্যবহারের চিত্র
বহুপাক্ষিক উন্নয়ন অংশীদারদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ দেয় এবং তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম সুদ নেয়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক ২ দশমিক শূন্য এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, যার মধ্যে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ছিল বাজেট সহায়তা।
বাজেট সহায়তা বাদ দিলে, বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প ঋণের মাত্র ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ অর্থ ব্যবহার হয়েছে।
এই পরিস্থিতি উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, ইআরডি ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে ত্রৈমাসিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হলেও অগ্রগতি তেমন নেই।
যার ফলে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ধীরগতির প্রকল্পগুলো থেকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার সরিয়ে নতুন অথবা চলমান প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে।
ব্যবহারে দেরি হওয়ায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পাইপলাইনে থাকা অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। গত বছর আরও ৮৩৩ মিলিয়ন ডলার যুক্ত হয়ে জুলাইয়ের শুরুতে পাইপলাইনে থাকা এই অর্থের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারে।
তবে এডিবি থেকে পাওয়া অর্থের তুলনামূলক ভালো ব্যবহার হয়েছে। গত অর্থবছরে এডিবি ২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, যার মধ্যে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ছিল বাজেট সহায়তা। বাজেট সহায়তা বাদ দিলে, পাইপলাইনের ২২ দশমিক ৪৪ শতাংশ অর্থ ব্যবহার হয়েছে।
দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন অংশীদারদের মধ্যে জাপান এখনো সবচেয়ে বড় ঋণদাতা। দেশটি স্বল্প সুদ ও দীর্ঘ মেয়াদের কিস্তিতে সহজ শর্তের ঋণ দেয়।
জুলাই পর্যন্ত জাপানের সঙ্গে পাইপলাইন থাকা অর্থের পরিমাণ ৩০৯ মিলিয়ন ডলার বেড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও, প্রকল্প ঋণের ব্যবহার হয়েছে সর্বোচ্চ ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের পর থেকে চীন প্রকল্প ঋণ দেওয়া শুরু করে। তবে, গত অর্থবছরে নতুন কোনো ঋণ অনুমোদিত হয়নি। আগে অনুমোদিত ঋণ থেকে মাত্র ৪১৪ মিলিয়ন ডলার ছাড় করা হয়েছে, অর্থাৎ মাত্র ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ অর্থ ব্যবহার হয়েছে।
রাশিয়া কেবল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, যার চুক্তি সই হয়েছিল ২০১৬ সালে।
গত অর্থবছরে রাশিয়ান ঋণের সাড়ে ১২ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। ৬৭৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হলেও জুলাইয়ের শুরুতে ৪ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার অব্যবহৃত ছিল।
ভারতীয় ঋণে প্রকল্পের গতি সবচেয়ে ধীরগতির। গত অর্থবছরে এর মাত্র ৩ দশমিক ১০ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে—অর্থাৎ ১৮৪ মিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের শুরুতে ৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার অব্যবহৃত ছিল।
২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারত ৭ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে জটিল শর্ত ও উভয় দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীরগতিতে।
প্রকল্পে বিলম্বের কারণ
এডিবির এক নথি অনুযায়ী, অধিকাংশ প্রকল্প, বিশেষ করে অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বাস্তবায়ন করা যায়নি।
এতে বলা হয়, প্রকল্প প্রস্তুতিতে আর্থিক ও মানবসম্পদ ঘাটতি, প্রকল্প ও দরপত্র সংক্রান্ত নথির জটিল ও দীর্ঘ অনুমোদন প্রক্রিয়া, জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও সম্পাদনকারী সংস্থাগুলোর অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং আরও বেশ কিছু কারণে প্রকল্প প্রস্তুতি দুর্বল থাকে। এর জন্য ঋণ বাস্তবায়নের সময়সীমা বারবার বাড়াতে হয়।
ঋণদাতা সংস্থাটি আরও উল্লেখ করেছে, ক্রয় প্রক্রিয়াতেও সমস্যা রয়েছে। যেমন: পর্যাপ্ত প্রকল্প প্রস্তুতি না থাকা, নিম্নমানের ডিজাইন, প্রকৌশল খরচের প্রাক্কলন বাজারমূল্যের সঙ্গে মিল না থাকা এবং দুর্বল দরপত্র নথি।
প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার কারণে বাংলাদেশকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।
উদাহরণস্বরূপ, এ পর্যন্ত মোট কমিটমেন্ট চার্জ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে ৩০ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন ডলার। শুধু ২০২৪ সালেই এ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৩ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার। উৎস: ডেইলি স্টার