মধ্যপ্রাচ্য হয়ে নিষিদ্ধ ক্রিম ঢুকছে চট্টগ্রামে। পাকিস্তানে তৈরি এসব ক্রিম পাঁচ বছর আগে ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেও প্রায়ই যাত্রীদের লাগেজ থেকে জব্দ করছে বিমানবন্দর কাস্টমস ও এনএসআই। গত ছয় মাসে আড়াই হাজারেরও বেশি নিষিদ্ধ ক্রিম জব্দ করা হয়েছে। তবে প্রতিবারই যাত্রীদের সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অতিমাত্রায় পারদ থাকায় ত্বকের জন্য ক্ষতিকর এসব ক্রিম ‘লাগেজ পার্টি’র মাধ্যমে এনে গোপনে বিক্রি করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এতে করে মারাত্মক চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
সোমবার (২২ ডিসেম্বর) রাত ১০টায় চার যাত্রীর লাগেজ তল্লাশি করে ৫০ পিস নিষিদ্ধ গৌরী ক্রিম জব্দ করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের কাছ থেকে ৮৬৭ কার্টন সিগারেটও জব্দ করা হয়।
চার যাত্রী হলেন—রেজাউল করিম, মিজানুর রহমান, রিদওয়ানুল হক ও মো. সালাউদ্দিন। তারা দুবাই থেকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে রাত সাড়ে ৯টায় চট্টগ্রামে পৌঁছান।
গৌরী ক্রিম মূলত তৈরি হয় পাকিস্তানে। দুবাই হয়ে এই নিষিদ্ধ ক্রিম চট্টগ্রামে ঢুকছে। এরপর দেশে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছে দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় ‘আকাশপথ’ ব্যবহার করে যাত্রীদের মাধ্যমে এসব ক্রিম আনা হচ্ছে। শুধু চট্টগ্রাম নয়, ঢাকা বিমানবন্দরেও কয়েক দফায় জব্দ করা হয়েছে এসব নিষিদ্ধ ক্রিম।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল জানান, জব্দ করা সিগারেটের আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৩০ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এসব সিগারেট এবং নিষিদ্ধ গৌরী ক্রিম চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের হেফাজতে আছে। ওই চার যাত্রীকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে।
গত ২২ নভেম্বর সকালে কাস্টমস এনএসআই ও কাস্টমস ইন্টেলিজেন্সের যৌথ তল্লাশিতে দুই যাত্রীর ব্যাগ থেকে জব্দ করা হয় ২৫০ পিস গৌরী ক্রিম। মো. ফখরুল ইসলাম ও মো. আশরাফুল ইসলাম নামে দুই যাত্রী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে করে চট্টগ্রামে আসেন।
৮ নভেম্বর সকালে দুবাইফেরত যাত্রীর মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনের কাছ থেকে ১২টি নিষিদ্ধ ক্রিম উদ্ধার করে এনএসআই ও শুল্ক গোয়েন্দা।
২০ জুলাই রাত সাড়ে ৯টায় দুই যাত্রী ইমিগ্রেশন শেষ করে ব্যাগেজ নিয়ে গ্রিন চ্যানেল (শুল্ককরযুক্ত পণ্য না থাকলে এই পথে যাওয়া যায়) অতিক্রম করার সময় এনএসআই কর্মকর্তারা তাদের তল্লাশি করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২ হাজার ৭৬ পিস গৌরী ক্রিম জব্দ করা হয়। দুবাই থেকে আসা ও দুই ছিলেন ফেনী সদরের মো. আরিফুল ইসলাম এবং চট্টগ্রামের রাউজানের মোশাররফ হোসেন। তাদের পাসপোর্ট নম্বর নথিভুক্ত করে জরিমানা করা হয় এবং সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
১৮ জুন মধ্যপ্রাচ্যের ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এই দুই যাত্রী কাছ থেকে ১৪০ পিস গৌরী ক্রিম জব্দ করা হয়। ওই দুই যাত্রী ছিলেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মোহাম্মদ আবু নাসের এবং নগরের চাঁন্দগাও থানা এলাকার মিন্টু দেবনাথ।
আসছে নিষিদ্ধ ‘ডিউ ক্রিমও’
চলতি বছরের ২৯ জুলাই আবুধাবিফেরত দুই যাত্রীর লাগেজ স্ক্যানিং করে পাকিস্তানে তৈরি নিষিদ্ধ ৯২০ পিস ডিউ ক্রিম জব্দ করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং বিমানবন্দর কাস্টমসের কর্মকর্তারা। দুই যাত্রী ছিলেন—ফেনীর ছাগলনাইয়ার বাসিন্দা নূর নবী এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বাসিন্দা মো. মিজানুর রহমান। তাদের পাসপোর্ট নথিভুক্তের পর সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নিষিদ্ধ ১৮ ক্রিম
পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ‘বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন’ (বিএসটিআই) ২০২০ সালে আটটি রং ফর্সাকারী ক্রিমে ক্ষতিকর মাত্রায় পারদ ও হাইড্রোকুইনোন পায়। এসব প্রসাধনী ব্যবহার করলে চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগ হতে পারে, এমন সতর্কতা জারি করে সেগুলো বিক্রি, বিপণন ও আমদানিনিষিদ্ধ করে সংস্থাটি। এই আটটি ক্রিমের একটি হলো ‘গৌরী ক্রিম’ ও ’ডিউ ক্রিম’ অন্যতম।
এরপর ২০২৩ সালের নিষিদ্ধের তালিকায় যোগ হয় আরও ১০টি ক্রিম। নিষিদ্ধ তালিকায় রয়েছে—পাকিস্তানের গৌরী কসমেটিকসের (প্রা.) ‘গৌরী ক্রিম’, এসজে এন্টারপ্রাইজের ‘চাঁদনী ক্রিম’, কিউসি ইন্টারন্যাশনালের ‘নিউ ফেস’, ক্রিয়েটিভ কসমেটিকসের ‘ডিউ’, নুর গোল্ড কসমেটিকসের ‘নুর হারবাল বিউটি ক্রিম’, নুর গোল্ড কসমেটিকসের ‘নুর গোল্ড বিউটি ক্রিম’, গোল্ডেন পার্ল কোম্পানির ‘গোল্ডেন পার্ল ক্রিম’, হোয়াইট পার্ল কসমেটিকস ইন্টারন্যাশনালের ‘হোয়াইট পার্ল ক্রিম’, পুনিয়া ব্রাদার্স (প্রা.) লিমিটেডের ‘ফাইজা ক্রিম’, লোয়া ইন্টারন্যাশনালের ‘পাক্স’ ও ‘নাভিয়া ক্রিম’, লাইফ কসমেটিকসের ‘ফ্রেশ অ্যান্ড হোয়াইট ক্রিম’, ফেস লিফট কসমেটিকসের ‘ফেস লিফট ক্রিম’, শাহিন কসমেটিকসের ‘ফেস ফ্রেশ ক্রিম’ ও আনিজা কসমেটিকসের ‘আনিজা গোল্ড’।
এছাড়া চীনের শুয়াংজ বায়ো টেকনোলজির ‘ডা. রাসেল নাইট ক্রিম’ এবং ভারতের অ্যারোমা কেয়ার কসমেটিকসের ‘ডা. ডেভি স্কিন লোশন’ বিক্রি ও বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নামবিহীন প্রতিষ্ঠানের ‘ফোর কে প্লাস’ এবং ‘জাওলি’ নামের দুটো ক্রিম রয়েছে নিষিদ্ধের তালিকায়।
গৌরী ক্রিমে পারদ ৭৫৫.৮৫ পিপিএম
বিএসটিআইয়ের ল্যাব পরীক্ষায় পাওয়া গেছে, গৌরি ক্রিমে পারদের পরিমাণ ৭৫৫.৮৫ পিপিএম—যেখানে গ্রহণযোগ্য মাত্রা মাত্র ১ পিপিএম! শুধু গৌরি নয়, বাজারের আরও সাতটি ব্র্যান্ডেও পাওয়া গেছে বিপজ্জনক মাত্রার পারদ ও হাইড্রোকুইনোন। তাই এসব ক্রিম আমদানি ও বাজারজাতকরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বিএসটিআই।
রং ফর্সা নয়, বরং ত্বক নষ্ট—এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় এ ধরনের ক্রিম। অবৈধভাবে বাজারে, এমনকি ফেসবুক পেজে এসব ক্রিম বিক্রির অভিযোগও দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে।