শিরোনাম
◈ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে আজ: সালাহউদ্দিন আহমদ (ভিডিও) ◈ সিলেট পৌঁছেছেন তারেক রহমান ◈ আজ রাজধানীতে চলাচলে মানতে হবে যেসব নির্দেশনা ◈ হাদি হত্যাকাণ্ডের পর নিরাপত্তা শঙ্কা: গুরুত্বপূর্ণ ১২৭ নেতা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ◈ ৩০০ ফিট ও কুড়িল এলাকায় জনসমাগম, প্রস্তুত ১৭ অ্যাম্বুলেন্স ◈ ১৭ বছর পর তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন: কনকনে শীত উপেক্ষা করে সূর্যোদয়ের আগেই পূর্বাচলে মানুষের ঢল (ভিডিও) ◈ সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন নির্দেশনা হাইকোর্টের ◈ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরীর পদত্যাগ ◈ হঠাৎ করে ওএমএসের চাল-আটা বিক্রি বন্ধ, বিপাকে দরিদ্র মানুষেরা ◈ দেশে ফিরতে সপরিবারে হিথ্রো বিমানবন্দরে তারেক রহমান (ভিডিও)

প্রকাশিত : ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৯:১১ সকাল
আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৯:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘প্রকল্প সোনাপাহাড়’: তিন বছরেই মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে গড়ে ওঠা এক গহীন অরণ্য

দূর থেকে কিংবা আকাশ থেকে পাখির চোখে তাকালে মাটি দেখা যায়না। চারদিকে শুধুই সবুজ ঘোর বন-জঙ্গল। সেই বনের ভেতরে ঢুকে পা বাড়ালেই মনে হবে গাছপালা লতাগুল্মের এ যেন এক জাদুঘর! শতাধিক প্রজাতির জানা-অজানা গাছ-গাছালি ডালপালা বিস্তার করে আছে। জানাচ্ছে সাদর সম্ভাষণ। বাতাসের মর্মর শব্দ বেজে ওঠে গাছের ডালে ডালে। হরেক জাতের পাখ-পাখালির কলরবে মুখরিত ছোট্ট অরণ্য। বুনো ফুলের গন্ধে বিভোর চারপাশ। শান্ত স্নিঘদতা আবেশ। গাঢ় সবুজের মেলায় শান্ত নির্মল প্রাণ-প্রকৃতির সহজাত নাচন। মনের অজান্তে হয়তো একটি বুনো পাখি গায়ের ওপর এসে বসবে।

এটি বিশাল কোনো বন-জঙ্গলের ঠিকানা নয়। আকার-আয়তনে ছোট এই বন সৃজন করা হয়েছে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের জোরারগঞ্জের সোনাপাহাড় এলাকায়। কাব্যিক নাম ‘প্রকল্প সোনাপাহাড়’। ছোট বড় মাঝারি অনেক প্রজাতির গাছ লতা-গুল্মের ঝোপে ভরপুর। অরণ্যের মাঝখান দিয়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকা সরু পথে পায়ে হাঁটা যায়। লাগোয়া দূরত্বে গাছপালা লতাপাতার সারি। খুব পরিপাটি করে রোপণ করা। গাছের ভিড় ঠেলে আকাশ থেকে সূর্যের আলোও যেন ঠিকমতো মাটি পড়ে না। প্রথম দেখায় মনে হবে, শতাধিক বছর যাবত গড়ে ওঠা ঘাস, লতাপাতার ঝোপঝাড়ে ঘন বন-জঙ্গল।

‘প্রকল্প সোনাপাহাড়’ নামক এই কৃত্রিম বন-জঙ্গল এবং ফার্মহাউজ গড়ে তোলা হয়েছে। যা ব্যক্তি-উদ্যোগে এক মহতি উদ্যোগ। মীরসরাই সোনাপাহাড়ে সৃজন করা হয়েছে একটি কৃত্রিম বনভূমি। সেখানে ৬ একর জায়গার মধ্যে আড়াই একরের ওপর গড়ে উঠেছে পরিকল্পিত বন (৪ হাজার ৪শ’ বর্গফুট জায়গায়)। ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে ২৫২ প্রজাতির গাছ-গাছালি ও লতাগুল্মের সমাহার। যা মাত্র তিন বছরেই পরিণত হয়েছে কয়েক যুগবর্ষী ছোট এক অরণ্যে। প্রকল্পের বাদবাকি জায়গায় রয়েছে শান্ত পানির ছোট হ্রদের ধারে পরিবেশবান্ধব কিছু অবকাঠামো মিলিয়ে ফার্মহাউজ।
স্থানীয় লোকজন জানান, এরআগে ওখানে টিলার ঢালু ও সমতল ভূমি কেটে-খুঁড়ে সাবাড় করে ইটভাটায় মাটি সরবরাহ করা হতো। জমির টপসয়েল বিরান হচ্ছিল নির্বিচারে। সেখানে সৃষ্টি হয়েছে চোখজুড়ানো সবুজ বন-জঙ্গল লতাগুল্ম।

‘প্রকল্প সোনাপাহাড়ে’র উদ্যোক্তা ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর আমজাদ হোসেন গতকাল সোমবার দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, প্রসিদ্ধ জাপানী মিয়াওয়াকি ফরেস্টের মডেলে এই ছোট্ট বন গড়ে তোলার প্রয়াস। তবে এতে আমি নিজে একক কোনো কৃতিত্বের দাবিদার নই। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পাওয়ারও কিছু নেই। গাছপালা, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এই উদ্যোগটি গ্রহণ করি। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের সম্পৃক্ত করে এগুচ্ছি। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার ১৮ কোটি মানুষ সদিচ্ছা থাকলে যে কেউ চাইলেই সেটা করতে পারেন। পরিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি, গাছপালার প্রতি শুধুই ভালোবাসা থাকলেই তা সম্ভব। এর ফলে মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির বাঁচার জন্য অপরিহার্য অক্সিজেন সরবরাহ ১০ গুণ বাড়বে। বাতাসে ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বিষাক্ত প্রভাব কমবে। বাঁচবে মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতি। জাপানের প্রখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আকিরা মিয়াওয়াকি হচ্ছেন ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট মডেল’ বা ধারণার প্রবক্তা। দেশীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মীরসরাই ‘প্রকল্প সোনাপাহাড়ে’ দেশের প্রথম ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ পদ্ধতির পরীক্ষামূলক কৃত্রিম বন বাস্তব রূপায়ন সফল হয়েছে।

এই মডেলে চট্টগ্রামের মীরসরাই-সীতাকু- পাহাড় রেঞ্জে সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে ওঠা বা প্রচলিত দেশীয় প্রজাতির গাছের বীজ ও চারা বেছে নিয়ে রোপণ করা হয়েছে। যেগুলো কালের বিবর্তনে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ সোনাপহাড় প্রকল্পে ইতোমধ্যে জরিপ চালিয়ে এ ধরনের অন্তত ২৫২টি প্রজাতির গাছপালা লতাগুল্ম খুঁজে পেয়েছেন। আমজাদ হোসেন জানান, সেখানে মোট গাছ-গাছালির মধ্যে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির। আর কিছু দুর্লভ প্রজাতির গাছ লাগানোর পরিকল্পনাও আছে।

‘প্রকল্প সোনাপাহাড়’ শুরু করার চিন্তা-ভাবনা কীভাবে আসে? এ প্রসঙ্গে উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেন বলেন, কয়েক বছর আগে আমার এক নিকটাত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে জায়গাটা দেখতে যাই। তখন সেখানে দেখি পরিত্যক্ত একটি মুরগির ফার্ম। লাগোয়া একটি ইটভাটা। কী করা যায় এ নিয়ে কয়েক মাস চলে আলোচনা। গাছপালা লাগানো এবং কৃষি-খামারের প্রতি যেহেতু আমার শখ ও ঝোঁক, তাই বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত রেখেই বনায়ন কাজ শুরু করি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে। এরইমধ্যে তিন বছরেরও কিছু বেশি সময়ের ব্যবধানে কমপক্ষে ২৫২ প্রজাতির গাছপালা, লতাগুল্মে ছেয়ে গেছে এই বন।

তিনি আরো জানান, মীরসরাইয়ের বিস্তীর্ণ পাহাড় শ্রেণির মধ্যে বারৈয়ারহাট থেকে সীতাকু- অবধি নিকট অতীতেও শত শত প্রজাতির গাছপালা, লতাগুল্মের গহীন অরণ্য ছিল। কালক্রমে মানুষের অপরিণামদর্শী আগ্রাসী হাতে পাহাড় ন্যাড়া হয়ে গেছে। আমরা সেই পাহাড়ে খুঁজে খুঁজে বিলুপ্ত প্রায় শতাধিক প্রজাতির গাছের চারা ও বীজ সংগ্রহ করেই সোনাপাহাড় প্রকল্পে রোপণ করে সফলতা পেয়েছি। গাছ লাগানো কোনো কঠিন কাজ নয়, সদিচ্ছা ও প্রকৃতির জন্য ভালোবাসাই যথেষ্ট। প্রখ্যাত জাপানী বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আকিরা মিয়াওয়াকির মডেলে এই ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ সৃজন হয়েছে।

উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেন বলেন, কোনো রকম বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই বন গড়ে তোলা হয়নি। সাউন্ড বা নয়েজ-মুক্ত নির্জন নিরুপদ্রব পরিবেশে একে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি যারা গাছপালা, প্রকৃতিপ্রেমী, অনুসন্ধানী শুধু তারাই এখানে পরিদর্শনে আসেন। দর্শনার্থীসহ দেশের জনগণের প্রতি আমাদের স্পষ্ট বার্তাটি হলো, আরণ্যক শান্ত উদ্ভিদ প্রকৃতিকে নীরবে দেখুন। উপভোগ, অনুভব এবং সংরক্ষণ করুন। আমরা প্রকৃতিকে উৎপীড়ন করিনা, সুরক্ষা দিয়ে থাকি। উদ্ভিদ, প্রাণ-প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই বেড়ে ওঠে। যেমন, কিছু ধান ছড়িয়ে দিলেই দেশের উর্বর মাটিতে অঙ্কুর, চারা ও গাছ সৃষ্টি হয়। এক সময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল সবুজ বনে ঢাকা ছিল। এখন তা বিপন্ন। ১৮ কোটি মানুষ গাছের চারা রোপণ করলে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়বে, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা কমবে, মানুষ ও প্রাণিকুল বাঁচবে। আমাদের দেশটি হবে বাসযোগ্য।

‘প্রকল্প সোনাপাহাড়ে’ কর্মরত প্রকৌশলী মো. শামীম শেখ জানান, আমাদের উদ্দেশ্য দেশের জনগণকে সচেতন করা। এক সময়ে যেখানে ইটের ভাটার জন্য টপসয়েল তুলে নেয়া হতো, আজ সেখানে সবুজ বন-জঙ্গল। মাটির উপরিভাগের উর্বর ও মূল্যবান টপসয়েল সৃষ্টি হতে শত, হাজার এমনকি লাখো বছর লেগে যায়। আমরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে টপসয়েল সুরক্ষা করছি। আজ পাখির চোখে দেখলে সবুজ আর সবুজ। বনে মাটি চোখে পড়েনা। প্রকল্পের আওতায় ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ গড়ে তোলা সুবাদে স্বাভাবিক কোনো বনের তুলনায় এই বন কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি হারে অক্সিজেন সরবরাহ করছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রায় শুন্যের কোটায় নামিয়ে আনছে।

তিনি বলেন, দেশে জনসংখ্যা অনুপাতে ২৫ ভাগেরও বেশি বন-জঙ্গল থাকার কথা; অথচ আছে মাত্র দশ ভাগেরও নিচে। গত কয়েক দশকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে কার্বন নির্গমন; ঘাটতি হচ্ছে প্রকৃতির দান অক্সিজেনের। পর্যাপ্ত বন-জঙ্গল সৃজন হলে অক্সিজেন বাড়বে। তাই ‘প্রকল্প সোনাপাহাড়’ মডেলে যাতে সারা দেশে বনায়ন কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে সেটাই আমাদের লক্ষ্য। পর্যটন বা বিনোদনের টার্গেটে এই বন তৈরি হয়নি বা উন্মুক্ত নয়। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রজাতির গাছপালার চারা ও বীজ দিয়ে সহজেই এ ধরনের বনায়ন সম্ভব। আমরা এই বনায়নে জৈব সার ব্যবহার করি। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিই না।

‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ কি
‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ মূলত বনায়নের এমন এক মডেল যা জাপানী উদ্ভিদবিদ ও উদ্ভিদ বাস্তুবিদ্যা বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আকিরা মিয়াওয়াকি উদ্ভাবন করেন। নেদারল্যান্ড এবং ভারতেও এই মডেল সফল প্রমাণিত হয়েছে। এই বনের মূল দিকটি হচ্ছে, প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মাত্র ১০, ১৫ কিংবা ২০ বা ৩০ বছরের মধ্যে শতভাগ জৈব, ঘন এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ বন সৃজন। এই মডেলে ছোট জমিতে কৃত্রিম বন সৃষ্টি করা যায়। এটি স্বাভাবিক বনাঞ্চলের তুলনায় ১০ গুণ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

অতিরিক্ত ঘন বন-জঙ্গল এবং প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ধারণ করতে সক্ষম। কোনো অঞ্চলের আবহাওয়া-জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সেই এলাকার পুরনো চেনা-পরিচিত গাছপালা, লতাগুল্মের স্থানীয় প্রজাতিগুলোই রোপণ বা বপন করা হয়। ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ অন্য সাধারণ বনাঞ্চল থেকে ৩০ গুণ বেশি পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ এবং তত পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে। ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ হচ্ছে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম এই দুই বনায়নের মিশ্রণ। স্থানীয় বিভিন্ন চেনা-জানা প্রজাতির সঙ্গে সেখানে উপযুক্ত ভিন্ন প্রজাতির গাছপালা জন্মানো হয়।

মীরসরাইয়ে ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ আদলে বনায়নের জন্য মাটিতে জৈব সার হিসেবে গাছের গুঁড়ি, খড় ও লতাপাতা ইত্যাদির পচা সামগ্রীর সার ব্যবহার করা হয়। পৃথক জায়গায় মাটি প্রস্তুত করে সেই বিশেষ মাটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিচ থেকে ওপরে কিছুটা ঢালু করে বিছানো থাকে। সেখানে দুই বর্গফুট জায়গার চার কোনায় চারটি করে গাছ লাগানো হয়।

বাংলাদেশে উত্তর চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার সোনাপাহাড় এলাকায় ‘প্রকল্প সোনাপাহাড়’ পরীক্ষামূলক এ ধরনের প্রথম প্রকল্প। যা সফলতার মুখ দেখেছে। সারা দেশের জন্য উজ্জ্বল সম্ভাবনার মডেল হতে চলেছে। 

সূত্র: ইনকিলাব 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়