 
    
রুকুনুজ্জামান, পার্বতীপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধিঃ দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্পের ১৩ কিলোমিটার ভবানীপুর-মধ্যপাড়া রেলপথের ৬ হাজার নাটবল্টু চুরি।
ভবানীপুর রেলস্টেশন থেকে পান্তাপাড়া-কালিকাপুর পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার রেললাইনের ২ হাজার ফিসপ্লেট (এমএসপ্লেট) ও ৪ হাজার ফিসবোল্ট চুরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মধ্যে গত সোম ও মঙ্গলবার ৬৩ লাখ ৪ হাজার টাকার বেশি রেল সম্পদ চুরি হয়েছে। দুর্বৃত্তরা দিনদুপুরে এসব নাটবল্টু খুলে নিলেও কর্তৃপক্ষ এখনো নির্বিকার। সরেজমিন দেখা গেছে, ফিসপ্লেট, নাটবল্টু, ফিসবোল্ট ও স্লিপারে মতো গুরুত্বপূর্ণ মালামালের কোনো অস্তিত্ব নেই রেলপথটির অধিকাংশ স্থানে।
জানা গেছে, এর আগে রেলপথের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে দুপাশের ৫ কিলোমিটার লাইন চুরি হয়। রেলপথ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় চুরির ঘটনা ঘটেছে। মৌলভী ডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক খন্দকার হাবিব বলেন, রেলপথটি সচল থাকলে আজকে চুরি হতো না। মধ্যপাড়া থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরত্ব পার্বতীপুর। এ অঞ্চলের রেলপথে যোগাযোগ হলে সময় ও খরচ কম লাগতো। সড়কপথে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে পার্বতীপুর শহরে প্রশাসনিক কাজ করতে হয়।
মধ্যপাড়া পলিপাড়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ভাষ্য, যে যেভাবে পারছে, চুরি করছে মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এর আগে তো ৫ কিলোমিটার রেললাইন চুরি ও রেলপাতও কেটে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। খনির ও রেলওয়ে একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, খনির সীমানায় রেলপথের দায়িত্ব মধ্যপাড়া পাথর খনি কর্তৃপক্ষের এবং বাইরের অংশের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষের।
পার্বতীপুরের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী (এইএন) আবু জাফর মো. রাকিব হাসান সাংবাদিকদের বলেন, এক মাস আগে রেলওয়ে মহাপরিচালক (ডিজি) আফজাল হোসেন স্যার ওই রেলপথ পরিদর্শন করেছেন। মধ্যপাড়া রেলপথ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই কাজ শুরু হবে। দীর্ঘদিন ধরে এ-পথে পাথর পরিবহন না হওয়ায় রেলপথটি পরিত্যক্ত অবস্থায়। প্রতিরাতে পাহারার ব্যবস্থা রয়েছে। দিনে চুরির বিষয়টি আমার জানা ছিল না। যেহেতু দিনে রেলপথে চুরি সংঘটিত না হয়, সেজন্য দিনে ওয়েম্যান দিয়ে পাহারার ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
খনি ও রেল সূত্রে জানা গেছে, মধ্যপাড়া পাথর খনির অর্থায়নে ১৯৯০ সালে ৭১৩ কোটি ১৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকা ব্যয়ে মধ্যপাড়া-ভবানীপুর রেলপথে ১৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০০৯ সালে নির্মাণ শেষ হয়। রেললাইন স্থাপনের কাজ সমাপ্ত করে ২০০৫ সালে রেল কর্তৃপক্ষ তা খনি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর ২০১১ সালে পার্বতীপুরের ভবানীপুর রেলস্টেশন থেকে মধ্যপাড়া খনি পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার রেলপথের বেশ কয়েকটি জায়গার ৭০টি স্লিপার (পাটাতন) চুরি যায়। এরপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় ওই পথে পাথরবাহী ওয়াগনের চলাচল। রেল ও খনি কর্তৃপক্ষ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত।
এ বিষয়ে পার্বতীপুর রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী/পথ (পিবউআই) মো. শেখ আল আমিন বলেন, মধ্যপাড়া খনির পাথর পরিবহনের জন্য পার্বতীপুরের ভবানীপুর রেলস্টেশন থেকে মধ্যপাড়া পাথর খনি পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়। নিজস্ব জনবল সংকট থাকা সত্ত্বেও প্রতিরাতে চুরি ঠেকাতে রেললাইন ১৩-১৪ ওয়েম্যান গ্যাং দিয়ে পাহারা দেওয়া হচ্ছে। গত দুই-তিন দিনে ৬ হাজার নাটবল্টু চুরির ঘটনা ঘটে। এসব চুরি যা হয়েছে সব দিনদুপুরে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।
২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট থেকে ভবানীপুর-মধ্যপাড়া রেলপথে (রাত ৮টা থেকে ভোর ৪টা) প্রতিরাতে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। চার্জার টর্চলাইট, জ্যাকেট ও লাঠি দেওয়া হয়। তিন মাসের মাথায় নষ্ট হয়ে যায় ১২টি চার্জার টর্চলাইট। নিজেদের কেনায় টর্চলাইট রেলপথে ব্যবহার করছেন বলে জানিয়েছেন ওয়েম্যানরা। ওই রেলপথে পাহারার কাজে নিয়োজিত ২০২৪ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভ্রমণ-ভাতার (টিএ) বিল পাচ্ছেন না বলে গ্যাং লিডার ও ওয়েম্যানরা জানিয়েছেন। তারা জানান, স্থানীয় হুমকি ও ইটপাটকেল ছোড়ার মাঝেও প্রতিরাতে পাহারাদারের দায়িত্ব পালন করেও টিএ বিল পচ্ছেন না।
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. ফরিদ আহম্মেদ বলেন, ভবানীপুর-মধ্যপাড়া রেলপথে প্রতিরাতে ওয়েম্যান দিয়ে পাহারা ব্যবস্থা রয়েছে। তারপরও যখন চুরির ঘটনা ঘটছে, তাহলে দিনে রেলপথ পাহারার ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
পার্বতীপুর রেল থানার ওসি মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, পরিত্যক্ত রেলপথে নাটবল্টু চুরির বিষয়ে থানায় কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া পরিত্যক্ত রেলপথ রেল থানার অধীনে নয়। পিআরবি ৫৫০ ধারায় পড়ে পার্বতীপুর মডেল থানার অধীনে।
মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী ডিএম জোবায়েদ হোসেন বলেন, সড়কপথে পাথর পরিবহন খাতো ব্যাপক আর্থিক অপচয় হচ্ছে। রেলপথে পাথর পরিবহনে খরচ কম হয়। সড়কপথে পরিবহনে অতিরিক্ত ব্যয় গুনতে হচ্ছে। রেলপথ সচল না চলায় সড়কপথে পাথর পরিবহন খরচ বাড়ায় এর প্রভাব পড়ছে পাথরের দামে।
ভবানীপুর রেলস্টেশন-মধ্যপাড়া রেলপথ সংস্কারে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী (সিই) মো. আহম্মদ হোসেন মাসুম বলেন, ভবানীপুর থেকে মধ্যপাড়া পাথরখনি পর্যন্ত রেলপথ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মধ্যপাড়া পাথর খনি তারা রেলপথে পাথর পরিবহনে ব্যবহার না করায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এখন তারা এই রেলপথ ব্যবহারে আগ্রহী দেখাচ্ছে। আমাদের দুই মন্ত্রণালয়ও মধ্যপাড়া-ভবানীপুর রেলপথ সংস্কার বিষয়ে আগ্রহী।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
