রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ের ওপর জনগণের সমর্থন আছে কিনা—তা যাচাইয়ের জন্য যে ভোট অনুষ্ঠিত হয় তাকে গণভোট বলে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ব্যালটে সিল দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় কিছু প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রশ্ন তৈরি করে ভোটারদের থেকে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ মত গ্রহণ করা হয়।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিনবার গণভোট হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দুটি ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ও তাদের কর্মসূচির প্রতি আস্থা সংক্রান্ত। তৃতীয়টি হয় রাষ্ট্রপতি থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় রূপান্তর নিয়ে। এবার চতুর্থ গণভোট আয়োজনের আলোচনা চলছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী যেটির বিষয়, জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত বিষয় অনুমোদন।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতির সুপারিশ সংক্রান্ত দুটি খসড়া জমা দিয়েছে। সেখানে গণভোট নিয়ে ব্যালটে যে প্রশ্ন থাকবে সেটি উল্লেখ আছে। প্রশ্নটি হলো- ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তপসিল-১-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত খসড়া বিলের প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’
এখন প্রশ্ন উঠছে, তপসিল-১-এ কোন কোন প্রস্তাব আছে? অন্তর্বর্তী সরকার কোন ক্ষমতাবলে গণভোট আয়োজনের আদেশ দেবে? আগের গণভোটগুলো কী নিয়ে এবং সেগুলোতে জনমত কতটা প্রতিফলিত হয়েছিল?
বাংলাদেশের সংবিধানে গণভোট নিয়ে কী আছে?
জাতিসংঘের সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত নথি এবং দেশের আগের ভোটগুলোর ধরন পর্যালোচনার ভিত্তিতে বলা যায়- সংবিধান প্রণয়ন কিংবা সংশোধন, কোনো আইন তৈরি বা বাতিল এবং শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে জনগণের মতামত চাওয়া হয়। গণমানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর উদ্দেশ্য থাকে বিধায় এই প্রক্রিয়া গণভোট নামে পরিচিত।
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে থাকা ‘রেফারেন্ডাম ইন কনস্টিটিউশন মেকিং প্রসেস’ নামের নিবন্ধে বলা হয়েছে, সংবিধান গ্রহণ বা সংশোধনের জন্য আয়োজিত গণভোট, অর্থাৎ সংবিধানগত গণভোট হলো গণভোটের প্রধান ধরনগুলোর একটি। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে বিশ্বের ৫০ শতাংশেরও বেশি লিখিত সংবিধানে কোনো না কোনোভাবে গণভোটের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বাংলাদেশে এর আগে হওয়া গণভোটগুলোতে ভোটারেরা ভোটদানের পদ্ধতি হিসেবে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ এই দুটি শব্দকে বাছাই করেছেন।
জাতিসংঘ বলছে, ১৯৮৯ সালের পর রাজনৈতিক রূপান্তর ও সাংবিধানিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী গণভোট ব্যবহারের হার বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সংবিধান সংশোধন বা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে গণভোটের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং বিশ্বের বহু সংবিধানে এ সংক্রান্ত বিধান যুক্ত হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে গণভোটের বিধান যুক্ত হয় দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। পরে সেটি পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাতিল করা হয়। চলতি বছরের জুলাইয়ে হাইকোর্ট এক রায়ে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল করেছেন।
দেশে গণভোটে কখনো কি না জয়ী হয়েছে?
দেশে প্রথম গণভোট হয় ১৯৭৭ সালে। ওই বছরের ২২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করে ৩০ মে গণভোট, আগস্টে পৌরসভা নির্বাচন এবং ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লক্ষ্যে সামরিক ফরমান বলে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের সংশোধন করেন। গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য ২ মে সামরিক আইন আদেশ জারি করেন। ৩০ মে গণভোট হয়।
ওই গণভোটে একটি কালো রঙের বক্সে ‘হ্যাঁ’ এবং অপরটিতে ‘না’ লেখা ছিল। এতে হ্যাঁ এর পক্ষে ভোট পড়ে ৯৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। না এর পক্ষে ভোট পড়ে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ।
দ্বিতীয় গণভোট হয় ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ। লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তখন ক্ষমতায়। এই ভোটের বিষয় ছিল- এরশাদের অনুসৃত নীতি এবং তার প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকা নিয়ে। এতে ‘হ্যাঁ’ এর পক্ষে ভোট পড়ে ৯৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। ‘না’ এর পক্ষে ছিল ৫.৫ ভাগ।
তৃতীয় গণভোট হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। ওই গণভোট হয়েছিল সংসদে ওঠা বিল ও তাতে রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেয়া না দেয়া নিয়ে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় যাওয়া নিয়ে। এতে হ্যাঁ এর পক্ষে ভোট পড়ে ৮৪.৩৮ শতাংশ। ‘না’ এর পক্ষে ছিল ১৫.৬২।
সুতরাং দেশের ইতিহাসে হওয়া তিনটি গণভোটেই ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়। উৎস: সময়নিউজটিভি।