বিমান দুর্ঘটনার স্মৃতি এখনও তরতাজা মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীদের। ভয়াবহ সেই দিনের পর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে তবুও মাইলস্টোনের বাচ্চাদের চোখের গভীরে এখনো লুকিয়ে আছে হারানোর বেদনা। তাদের মুখের হাসি ফিরে এলেও, মনের কোণে রয়ে গেছে কিছু না বলা কষ্ট, কিছু অসমাপ্ত গল্প।
আজ আমাদের ছুটি ওভাই আজ আমাদের ছুটি। সেই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার স্মৃতি তাড়ানোর জন্য এক ব্যতিক্রমী আয়োজন। ছোট্ট শিক্ষার্থীরা সারাদিন মেতে উঠে ছবি আঁকা আর খেলায়। ফাঁকে ফাঁকে কাউন্সেলিং। মঙ্গলবার সারাদিন রোটারী ক্লাব অব বনানী ও ছুটি রিসোর্ট পূর্বাচল এর যৌথ উদ্যোগে ছুটি রিসোর্ট পূর্বাচলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ছবি আঁকা, খেলা, গল্প আর গান-সবকিছুতেই ছিলো এক অন্যরকম আবহ।
আনন্দে ভরে ওঠে চারপাশ, কিন্তু প্রতিটি হাসির আড়ালেই লুকিয়ে ছিলো গভীর স্মৃতি, প্রিয়জন হারানোর ব্যথা। একদিনের জন্য হলেও তারা ভুলে থাকতে পেরেছে সেই ভয়াবহ দিন। সেই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার স্মৃতি তাড়ানোর জন্যই এই অনুষ্ঠান। ছোট্ট শিক্ষার্থীরা সারাদিন মেতে উঠে ছবি আঁকা আর খেলায়। ফাঁকে ফাঁকে কাউন্সিলিং। অংশ নিয়েছিল মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির বেদনা বয়ে বেড়ানো প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থী। দিনব্যাপী কর্মসূচিতে ছিল মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সেশন, ছবি আঁকা, ট্রেজার হান্ট প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা এবং সবশেষে নিজেদের কষ্ট কাগজে লিখে তা দিয়ে নৌকা বানিয়ে নীল জলে ভাসিয়ে দেওয়ার প্রতীকী আয়োজন।
এমন আয়োজনরে পেছনের আয়োজনটির গল্পটি জানালেন গনমাধ্যম কর্মী শাহনাজ শারমীন। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি কাভার করতে করতে দেখলেন শিশুদের চোখে গভীর বেদনা। তখন সবাই কাউন্সিলিংয়ের কথা বলছিলো। কিন্তু শিশুরা খেলা, ছবি আঁকা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বেশী পছন্দ করে তাই এসব কিছু নিয়ে একটি কার্নিভালের চিন্তা করি। সেখানে নানা কর্মকান্ডেরে মধ্যদিয়ে শিশুরা তাদের মনের কথা বলবে। এ চিন্তা থেকেই করেছি । সহায়তায় এগিয়ে আসে রোটারী ক্লাব অব বনানী ও ছুটি রিসোর্ট পূর্বাচল।
তাহসিন আব্দুল্লাহ, মাইলস্টোন স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। দুর্ঘটনার দিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ অস্বাভাবিক শব্দ শুনে দৌড়ে ফের স্কুলে আসে।
সে জানায়, “দেখি বিমান পড়ে আগুন লেগেছে। হন্য হয়ে বোনকে খুঁজতে থাকি। একসময় দেখি, পোড়া দেহ নিয়ে বেরিয়ে আসছে। দ্রæত হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু কয়েকদিন পর বোনটা চলে গেল চিরতরে।”
চোখের জল মুছতে মুছতে তাহসিন বলে, “আমরা দুই ভাইবোনের বয়সের পার্থক্য তেমন ছিল না। সবকিছুর সঙ্গী ছিল বোন। তাকে হারিয়ে মনে হয়, আমরা একটা পার্টনার হারিয়েছি।”
সূর্য সময়, সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আগুনের ভেতর থেকে একে একে বন্ধুদের নামিয়ে আনে সে।
তার ভাষায়, “আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না। নিজের জামা দিয়ে মুখ ঢেকে জানালার পাশে গিয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করেছি। পরে বন্ধুরা পড়ে আছে দেখে একে একে সবাইকে উদ্ধার করেছি, তারপর নিজে নেমেছি।”
রোটারি ক্লাব বনানীর প্রেসিডেন্ট খন্দকার আব্দুল মুবিন বলেন, “এটা শুধু বিনোদন নয়; বরং শিশুদের মনের ভয়, দুঃখ ও চাপ দূর করার এক আন্তরিক প্রয়াস।”
ছুটি রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর ফেরদৌস জানান, “মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। এমন উদ্যোগে যুক্ত হতে পেরে আমরা আনন্দিত।”
মাইলস্টোনের সিনিয়র লেকচারার অভিজিত অধিকারী বলেন, “ট্র্যাজেডির পর থেকে প্রতিদিনই চেষ্টা করছি— ওদের ট্রমা যেন হালকা হয়, যেন আবারও হাসতে পারে, স্বপ্ন দেখতে পারে। আজকের আয়োজন সেই প্রচেষ্টাকে আরও দূর এগিয়ে দিল।”
মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি লিড মনিরা রহমান বলেন, “এমন আয়োজন শিশুদের মানসিক পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। তারা আবারও বন্ধুর মুখে হাসি দেখে বিশ্বাস পায় জীবন থেমে থাকে না।”
চিত্রশিল্পী তাহমিনা হাফিজ লিসা বলেন, ‘বাচ্চারা ছবি আঁকছে কারো ছবিতে চোখের জল, কারো ছবিতে সেই স্মৃতি, তাদের আঁকা ছবিগুলো যেন সাক্ষ্য দিচ্ছিল-স্মৃতির রঙ কখনোই পুরোপুরি মুছে যায় না।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারী ইনিস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন,যুগ্ম পরিচালক ডা. মারুফুল ইসলামও অংশ নেন এ অনুষ্ঠানে।
২১ জুলাই ২০২৫ তারিখে ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি দোতলা ভবনের ওপর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীসহ অন্তত ৩৫ জন নিহত এবং প্রায় ১৫০ জন আহত হন। সূত্র: ইত্তেফাক