অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়ার মাধ্যমে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে বিজয়ের স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়া, ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এখানে বক্তব্য ইত্যাদি নানা কারণে উদ্যানটি অনন্য এক ঐতিহাসিক স্থান হয়ে উঠে। সুতরাং এই স্থানটিতে কিছু স্থাপনার মাধ্যমে স্মরণীয় করার উদ্যোগ নেওয়া খুবই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু একইসঙ্গে ঢাকা শহরের বাস্তবতাও মাথায় রাখতে হবে। ঢাকা শহরকে হত্যা করা হয় এমন কিছু করলেই এর বিশেষত্বইতো আর থাকবে না। এই মেগা শহরে খোলামেলা স্থান এবং সবুজের খুবই অভাব। বিশেষ করে এটি ৩৫ হাজার ছাত্রছাত্রী ও হাজার হাজার শিক্ষক কর্মচারীর বিকারণ ক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে হওয়াতে এটিকে সবুজ রাখার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে এখানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণসহ অন্যান্য প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ২১ বছর পর প্রথম ক্ষমতায় আসে তখন। সেই সময় উম্মুক্ত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্বাধীনতা স্তম্ভের নকশা করে বিজয়ী হয়ে মেরিনা তাবাস্সুম স্তম্ভ নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ পান। তারপর ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে এই কাজ অনেকটা থেমে যায়। আবার যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এই কাজ আবার গতি পায়। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি অ্যাওয়ার্ড উইনিং আর্চিটেক্ট মেরিনা তাবাস্সুম এবং তার প্রতিষ্ঠান এই কাজ থেকে বাদ পরে যান। এসব বাদানুবাদে পরে স্থপতি মোবাশ্বের, বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামিলুররেজাসহ অনেকেই এ থেকে পদত্যাগ করেন। তারপরই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তরাই হয়ে উঠেন এর বিশেষজ্ঞ। আর তখন থেকেই শুরু হয় মূল নকশা থেকে বিচ্যুতি। তখন থেকেই শুরু হয় রেস্তোরাঁ বানানো, পার্কিং স্পেস করা ইত্যাদি তৈরির নামে গাছ কাটার পরিকল্পনা। দুদিন আগে শুনলাম এই কাজে সংশ্লিষ্ট একজন বলছেন যে বর্তমানে যেই গাছগুলো আছে এইগুলো পরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়নি। তারা পরিকল্পিতভাবে এই গাছগুলো কেটে পরিকল্পিতভাবে ফুলের গাছ লাগিয়ে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন করবেন। আমরাতো ফুলের বাগান চাই না। আমরা চাই বড় বড় গাছ। যেই গাছ পরিবেশকে সুন্দর রাখবে।
প্রশ্ন হলো কার স্বার্থে মেরিনা তাবাস্সুম ও তার প্রতিষ্ঠান এই কাজ থেকে বিতারণ করা হলো। কেন এই কাজ করতে গিয়ে দেশ বরেণ্য স্থপতি ও পরিবেশবিদদের সাথে আলোচনা করা হয়নি? কেন উন্নয়ন মানেই কংক্রিট স্থাপনা করতে হবে? আমি যখন জার্মানিতে ছিলাম তখন বার্লিনার পটসডামে থাকতাম। ওখানে বেশ কয়েকটি পার্ক আছে। এর মধ্যে একটি প্রাসাদ প্লাস পার্ক শানসৌসি। বিশাল এক পার্ক। প্রায় ৩০০০ ফলের গাছ। সেই পার্কের মধ্যে দিয়ে হেঁটেই আমি পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম যেখানে আমি পোস্টডক করতাম। সেই পার্কে পায়ে হাঁটার রাস্তাগুলো ছিল নুড়ি পাথরের গুঁড়ো দিয়ে তৈরী। ওখানে হাঁটার রাস্তাগুলো কংক্রিট দিয়ে তৈরী ছিল না। আমরাও কি পারতাম না এইরকম করে হাঁটার রাস্তা তৈরী করতে। কেন রাস্তা মানেই কংক্রিট? ওখানে কেন রেস্তোরাঁ করতে হবে? কেন ওখানে পার্কিং লট বানাতে হবে? আমাদের উচিত এই উদ্যানটিকে সর্বোচ্চ সংখ্যক গাছ রেখে সবচেয়ে কত কম কংক্রিট ব্যবহার করে ঐতিহাসিক স্মৃতি স্থাপনা তৈরী করা যায়।
দুইদিন আগে দেখলাম এক মন্ত্রী একটা স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেছেন, জিয়াউর রহমান যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি অংশকে শিশু পার্ক বানানলেন তখন কি কেউ প্রতিবাদ করেছিল? এখন যারা প্রতিবাদ করছে তখন তারা কি প্রতিবাদ করার বয়সে ছিলেন? তখনকার প্রেক্ষাপট আর এখন প্রেক্ষাপট কি এক? তখন ঢাকা শহরের জনসংখ্যা অনেক কম ছিল। ঢাকা শহরের প্রতিটি বাড়িতে অনেক গাছ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক খালি জায়গা ও গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ ছিল। এছাড়া বিশ্ব এখন পরিবেশ নিয়ে অনেক বেশি সোচ্চার। পরিবেশ বিপর্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ খুবই নাজুক অবস্থানে। আমাদের ঢাকা শহরের ওপরে মিথেন গ্যাস পাওয়া যায়, ঢাকা শহর বিশ্বে অবাসযোগ্য দেশের মধ্যে ১ থেকে ৩ নম্বরে থাকে, এখানকার বায়ু মারাত্মক দূষিত। এই প্রেক্ষাপটে গাছই আমাদের পরম বন্ধু। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আর একটি গাছও কাটা যাবে না। কাটতে দেওয়া উচিত না। লেখক : শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়