কাজী হানিয়াম মারিয়া: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কেটে সেখানে সাতটি রেস্টুরেন্ট, ৫০০ গাড়ি রাখার পার্কিং এবং স্বাধীনতার স্তম্ভ তৈরির একটি সংবাদ এবং এর প্রতিবাদে সয়লাব নিউজফিড আমার। পরিবর্তন হতে হতে এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানটার আজ বেহাল অবস্থা। রমনা রেইসকোর্স উদ্যানটি আসলে ঢাকার সম্ভ্রান্ত নবাব এবং ধনীদের এলাকা ছিলো। ফলশ্রুতিতে উদ্যানের কোণঘেঁষে অভিজাত ঢাকা ক্লাবের জন্ম যেটা এখনো বড়লোকদের এলাকা বলেই পরিচিত। পাকিস্তান আমলেই উদ্যানটিতে ঘোড়াদৌড় বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক গুরুর নামে উদ্যানটির নতুন নামকরণ করেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। পরবর্তী সময়ে অনেক গাছ লাগানো হয় উদ্যানের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাছের সংখ্যা কমতে থাকে। বর্তমান সরকার তার পূর্ববর্তী মেয়াদের সময় শিখা চিরন্তন এবং স্বাধীনতার স্তম্ভ নির্মাণ করেন। সেই স্তম্ভের জনতার দেয়াল এবং কৃত্তিম লেকের কারণেও বেশ গাছ কাটা পরে। এখানে স্বাধীনতার যাদুঘর থেকে শুরু করে মুক্তমঞ্চ এবং বইমেলার বৃহৎ অংশও এখানেই হয়। ফলে আগের তুলনায় গাছের সংখ্যা বেশ কমে গেছে। এখন আবার গাছ কেটে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রের এই উদ্যানটিতে রেস্তোরাঁ এবং কার পার্কিং বানানোর প্রয়োজনীয়তা পরলো কেন?
এসব যখন ভাবছি তখন মনে মনে হিসাব করছি আমি জীবনে কতবার এই উদ্যানটির ভেতরে গিয়েছি। ২০০১ থেকে ২০২১ সাল- এই ২০ বছরের মাঝখানের কয়েকবছর বাদে আমি নিয়মিত এই উদ্যানের সামনে দিয়ে কার্জনে যাই। কিন্তু সর্বসাকুল্যে হাতে গুণে ১০ বারও আমি যাইনি যদিও বইমেলার হিসেব আলাদা। তখন উদ্যান দোকানে মোড়ানো হয়। আমার মনে হয় এরকম না যাওয়া পাবলিকের সংখ্যা একেবারেই কম না। কেন, উত্তর আমরা সবাই জানি। উদ্যানের পরিবেশ একেবারেই বেড়ানোবান্ধব নয়। ছিনতীইকারী, ভাসমান পরিবার, টোকাই, ভিক্ষুক, অসংখ্য ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। প্রথমদিকে লেক এবং জনতার দেয়ালের পাশটি বেশ চমৎকার ছিলো। তারপরই আমরাই চিপসের/আচারের খোসা, পানির বোতল, মাদকদ্রব্যের পরিত্যক্ত অংশ থেকে শুরু মানুষের একান্ত আদিম সম্পর্কের ব্যবহৃত অংশও পরে থাকতে দেখা যায়। সেই তুলনায় রমনা পার্কের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। এতো নেতিবাচক কথা বলার মানে এই নয় যে গাছগুলো কেটে ফেললে কিছু যায় আসে না। অনেক কিছু যায়। কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়ার মানে হলো গাছগুলো না কেটে বরং উদ্যানটির রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। উদ্যানটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের পাশাপাশি এর একটি নান্দনিক রূপ বর্তমান নগরজীবনে বেশ ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আমাদের ইটপাথরের শহরে আর কতো রেঁস্তোরা দরকার যে আমাদের মাঠগুলোতেও রেস্তোরাঁ বানাতে হবে?
ঢাকা শহরে বেড়ানোর জায়গা কটা আছে মনে করে দেখুন তো। বেড়ানো মানে কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে উদরপূর্তি করা নয়। দুদিন পর পর একটা/দুটা খোলা জায়গা তৈরি হয়, কদিনের মধ্যেই সেগুলোও ফুডকোর্টে পরিণত হয়ে যায়। এক হাতির ঝিল (হোক সেটা কৃত্তিম) নগরের মধ্যে একটু মুক্তস্থান তৈরি করেছিলো কিন্তু মানুষের চাপে সেখানে যাওয়াও এখন স্বস্তিকর নয়। একটা দমবন্ধকর শহরে পরিণত হয়েছে ঢাকা। কোন বোকার মাথায় এসব আসে যে গাছ কেটে রেস্তোরাঁ বানানো? উন্নয়নকে অবকাঠামোতে কে বেধে ফেলেছে! বোটানিক্যাল গার্ডেনের অবস্থাও যাচ্ছে তাই। বর্তমানে যেসব উদ্যান আছে এগুলোকে একটু রক্ষণাবেক্ষণ করা হোক। রেস্তোরাঁ বানানোর মতো এতো টাকা লাগবে না। আমাদের এতো গাড়িরও দরকার নেই। এমনিতেই ট্রাফিকের যন্ত্রণায় নগরবাসী অস্থির। আমাদের ব্যস্ত জীবনে নিরিবিলি একটু পরিবেশ দিন, যেখানে বসে দেশের পতাকায় কেন সিংহভাগ সবুজ তার মর্মটা বুঝতে পারি। সামনে বর্ষা আসছে। পারলে আরও গাছ লাগিয়ে একটু শান্তির নিরিবিলি পরিবেশ দিন। আমাদের পায়ে হাঁটতে দিন, মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে দিন। দুটো দিন প্রিয়মানুষদের সঙ্গে একটু বেশি বাঁচতে পারবো। ফেসবুক থেকে