নাঈমুল ইসলাম খান: [১] সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ, মামলা, তার বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা এবং সর্বশেষ তার আগাম জামিনের আবেদনে শুনানি না হওয়া, বাংলাদেশে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
[২] রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় অভূতপূর্ব, স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক আইনানুগ প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে, অন্যভাবে বলতে গেলে এই ঘটনায়, আইন বিনা বিলম্বে যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত আপন গতিতে চলছে সেখানে মিডিয়ার ভূমিকা কিছুটা গুরুত্ব হারিয়েছে বটে।
[৩] মূলধারার মিডিয়ার বিশেষ কোনো উৎসাহ বা প্রবল চাপাচাপি ছাড়াই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, অপরাধী যতো বড় প্রভাবশালীই হোক ছাড়া পাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে এই কথাগুলো স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত মনে হয়েছে।
[৪] পুলিশের ভূমিকাও শুরু থেকে ব্যতিক্রমধর্মী, স্বতঃস্ফূর্ত, সক্রিয়, স্বাধীন এবং দ্ব্যর্থহীন মনে হয়েছে। মামলা গ্রহণে তাদের আগ্রহ অনেকখানি মামলা আমন্ত্রণের পর্যায়ে ছিলো। অভিযোগ ও আসামীর নাম, পরিচয় প্রকাশে পুলিশের সঙ্গে চাপাচাপি খোঁচাখুঁিচ করতে হয়নি। পুলিশ যেনো সবকিছু বলার জন্য মুখিয়ে ছিলো। চাহিবা মাত্রই তথ্যগুলো পাওয়া গিয়েছে।
[৫] বসুন্ধরা গ্রুপের সংবাদ মাধ্যমগুলো সরাসরি তাদের মালিকের বিরুদ্ধে এই মামলার খবর প্রকাশ না করাটা বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে কোনো নতুন বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা মোটেই না। বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যবসায়িক মালিকানাধীন সংবাদপত্র তাদের এবং তাদের বিরুদ্ধে আনিত, উত্থাপিত খবর সাধারণত প্রকাশ করে না। তাই বর্তমান ঘটনায় আমাদের নতুন করে অতিরিক্ত হতাশ হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। এটা দীর্ঘদিনের দুঃখজনক সূত্র।
[৬] বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, নির্দিষ্ট সংবাদপত্রমালিক ওই সংবাদপত্রের গলায় বেঁধে যতটুকু দীর্ঘ দড়ি খোটা দিয়ে নির্ধারণ করে দেন, স্বাধীনতার সীমানা ততোটুকুই।
[৭] মালিকের বেঁধে দেওয়া ওই সীমানার ভেতর আরও আছে বিজ্ঞাপনদাতার প্রভাবে স্বাধীনতাহীন/পরাধীন কিছু ছিটমহল।
[৮] তারপরে আরও আছে দলীয় আনুগত্যে সাংবাদিক সমাজের বিভক্তির জন্য সৃষ্ট আরও কিছু ছিটমহল।
[৯] রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক আইন-কানুনের ভয়ে সেলফ-সেন্সরশিপে মিডিয়া কাভারেজ থেকে ‘ছিটমহল’ রয়েছে আরও কিছু।
[১০] সংবাদপত্রের সামর্থ্যরে অভাবে, সাংবাদিকের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার অভাবে অথবা বিভিন্ন পক্ষের দাপটের ভয়ে মিডিয়া কিছুই করে না, তাকায়ওনা এমন ক্ষেত্রতো রয়েছেই।
[১১] এতোকিছুর পরেও এই দেশে অনেক মিডিয়াকে অনেক সময় নিরুৎসাহিত ও নিস্ক্রিয় করে রাখা সম্ভব হলেও কোনো না কোনো সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম প্রায় প্রতিটি অন্যায় অনিয়ম উন্মোচন করে বলেই আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি। কখনো হয়তো ক্ষীণ বা মুষ্টিমেয় মিডিয়ায় সেটা প্রকাশ হয়, কিন্তু হয়।
[১২] বর্তমান সামাজিক মাধ্যমের দাপটপূর্ণ এই সময়ে শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মূল ধারার সংবাদপত্র যদি কখনও কোনো কিছু চেপে যায় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কারও রক্ষা হয় না। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেটা প্রকাশিত হয়। তারপর সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে মূলধারার মিডিয়া একটু দেরিতে হলেও হয়তো একটু কম কিন্তু বিষয়টা কাভার করতে শেষ পর্যন্ত বাধ্যই হয়।
[১৩] একটি সংবাদপত্রে কারও সম্পর্ক যতো গভীর এবং নিবিড় সেই সংবাদপত্রে তার কোনো অপকর্মের খবর ছাপা হবে না।
[১৪] কোনো পত্রিকার সাথে কারও সম্পর্ক যদি কোনো কারণে বৈরি বা শত্রুতার হয় তার যেকোনো ভুল ত্রুটি অন্যায়ের ব্যাপারে সেই পত্রিকায় অব্যাহতভাবে বিধ্বংসী প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদন হবে।
[১৫] কোনো সংবাদপত্রের সাথে পরিচয় নেই এমনকি যাকে কেউ মোটেই চেনে না এমন মানুষের অনেক অন্যায় বা অপরাধের ব্যাপারে অনেকে খোঁজই পাবে না। প্রতিবেদন করার তো প্রশ্নই আসে না।
[১৬] কারও যদি সমাজে সাধারণভাবে ইতিবাচক ইমেজ থাকে এবং হঠাৎ কোনো অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন এমন ক্ষেত্রে সংবাদিকতা হবে নিয়মিত অথবা স্ট্যান্ডার্ড প্রসেস এবং প্রসিডিউরে।
[১৭] অনেক মানুষ থাকেন যাদের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সাংবাদিকদের মধ্যে প্রচুর বন্ধু থাকেন, শুভানুধ্যায়ী থাকেন, তাদের ব্যাপারে যদি কোনো অনিয়ম অন্যায় খবর তৈরি হয়, এই খবরও আতুর ঘরেই হত্যা করা হয়ে থাকে। সংবাদপত্রে সংবাদপত্রে কিছু ঘনিষ্ঠতার গ্রুপিং থাকে, উপদল থাকে। এক দলের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের প্রতিকূলে যায়, তেমন কোনো কিছু ওই গ্রুপের কোনো সংবাদপত্রই প্রকাশ করে না।
[১৮] আমরা যখন নাগরিকের জানার অধিকার এবং সংবাদপত্রের আলোচনা করি, তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বহুল আলোচিত হয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন জাগে কেউ কি একটু খাটাখাটনি করে, তথ্যানুসন্ধান করে দেখবেন আমাদের সংবাদপত্র সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থ এবং সম্পর্কের খাতিরে প্রতিদিন যতো খবর নিজেরাই হত্যা করেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জন্য সে তুলনায় কত শতাংশ বিঘ্ন তৈরি হয়?
[১৯] সব আলোচনা সমালোচনা শেষে সাংবাদিকতার শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, প্রতিটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের যার যার নিজস্ব বিচ্যুতির কারণে কোনো কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠান মাঝে মাঝে ব্যর্থতা দেখাবে কিন্তু সকল প্রতিষ্ঠান সব সময়, সব বিষয়ে ব্যর্থ হয় না, এখানেই আমাদের শেষ ভরসা। অনুলেখক: ফাহমিদা তিশা