রাশিদুল ইসলাম : প্রথমে আপনাকে সমবেদনা জানাচ্ছি, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিশেষ করে আপনাদের মতো দুটি পরিবারের মতো অনেক পরিবার এখন বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে এবং এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ না পেলে এ সমাজে আরো দিহান ও আনুশকার সর্বনাশ ঘটে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সমাজের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন বা ইমেইল বার্তা দিয়েছেন বলে কিছু কথা আপনাকে বলছি। দিহানের মতো সন্তানের একজন মা হিসেবে আপনি সমাজের কাছে আবেদন করেছেন আপনার ছেলেকে যেন ধর্ষক না বলা হয়, কিংবা হত্যাকারী? তাহলে আনুশকা’কে ফিরিয়ে দিন? আপনি যেমন দিহানকে জন্ম দিয়েছিলেন ঠিক তেমনি আনুশকাকে তার মা ১০ মাস ১০ দিন পেটে ধরে রেখে ছিলেন, কই আপনি তো এখনো আনুশকার মায়ের পাশে দাঁড়াননি, তাকে ও তার পরিবারের কাছে সমবেদনা জানাতে আপনার পরিবারের কেউ গেছে কি? কথার মারপ্যাঁচে আপনি দিহানের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন? দেখুন খুনি, ধর্ষক, দরবেশ প্রতিটি মানুষকে তার মা যখন সন্তান হিসেবে জন্ম দেন তখন সে শিশুই থাকে? ১৮ বছর ৭ মাস বয়স কেনো, দিহানের বয়স ৫০ বছর হলেও প্রতিটি মায়ের কাছে তার সন্তান যেমন, যেমন আনুশকা, তেমনি আপনার সন্তানও শিশু মনে হয়। খুনীর যখন ফাঁসীর দণ্ড হয় তখনো তা শুনে অপরাধীর মা বলে আমার ছেলে খুন করতেই পারে না। অথচ ওই মায়ের অন্ধ বিশ্বাসের কারণেই কবে কখন কোথায় সেই সন্তান খুনী হয়ে গেছে তা টেরও পাননি সেই মা।
এবার আপনি আপনার ও আপনার পরিবারের দিন যাপনের দিকে ফিরে তাকান, কীভাবে কোন পরিবেশে দিহানকে মানুষ করেছেন, তার আচরণ, সে কেমন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলা মেশা করেছে তা ভাবুন? সাহস থাকলে আত্মসমালোচনা করুন, আপনার দিহান অবশ্যই প্রথম দর্শনেই যৌনতায় মিলিত হতে চায়নি? এজন্যে দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা তার মন মানসিকতা আপনাদেরই পরিচর্যায়, জীবনযাপনের স্ট্যাটাসে সে মনে করেছে বিয়ের আগে প্রেমিকার সঙ্গে যৌনতা করা যায় তা যদি বিকৃতও হয় এবং তা করতে যেয়ে একবারও দিহান ভাবার অবকাশ পাননি যে আনুশকার রক্তক্ষরণ হতে পারে, সে মারা যেতে পারে। কি সহজে, কি অবলীলায়, আপনি বলছেন আপনার দিহানকে সমাজ খুনি বলবে না? আনুশকা আপনার মেয়ে হলে দিহানকে আপনি কি বলতেন? শিশু? ধর্মের অনুশাসন তো দূরের কথা, বাংলাদেশের সামাজিক সংস্কৃতির পটভূমি তো দূরের কথা, সাধারণ নীতি নৈতিকতাও কি বলে যে আপনার ছেলে তার প্রেমিকাকে এনে যৌনতায় প্রবৃত্ত হবে এবং মেয়েটি রক্তক্ষরণে মারা যাবে। সেটি সাধারণ ঘটনা বলে মনে করবেন এবং তা ভাবতে আমাদের কাছে আবেদন জানাবেন?
আপনি বলেছেন এই ঘটনায় হতবাক, মর্মাহত ও ন্যায়বিচার চান। কিসের ন্যায়বিচার, কেনো হতবাক, মর্মাহতই বা কেনো? দিহানকে যে পরিবেশ ও পরিচর্যায় আপনি তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন সে জন্যে সমাজ অনেক আগে থেকেই হতবাক, মর্মাহত ও ন্যায়বিচার চাচ্ছে? আনুশকার পরিবারের সঙ্গে আপনার পরিবারের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। দিনের পর দিন আপনাদের দুটি পরিবারের মধ্যে যাওয়া আসা ছিল। আপনাদের সম্মতিতেই দিহান ও আনুশকার সম্পর্ক এই মর্মান্তিক পরিণতি লাভ করেছে। এর দায়ভার আপনাদের। হতবাক হবার সুযোগ নেই। মা ও নারী হিসেবে এ ধরনের ঘটনা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর হলে আগে কেনো সাবধান হননি, দুটি পরিবারই পারিবারিক অনুশাসনে কেনো ছেলে ও মেয়েটিকে এ পরিণতিতে ঠেলে দিয়েছেন। ভাবুন একবার আনুশকা যখন বাড়ি থেকে কিনা খুশি মনে বের হয়েছিল কিন্তু তাকে যখন হাসপাতালে যেতে হয়েছে তখন কি ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। এই দুঃসহ জীবন যাত্রার পাটাতন আপনাদের মতো অভিভাবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে টাকা, যশ, প্রভাব প্রতিপত্তির মোহে তো নিজেরাই সৃষ্টি করেছেন। দুই দিন সময় নিয়েছেন ঘটনা বুঝতে? এতোদিন অবুঝ ছিলেন। মায়ের শাসন কোথায় ছিল আপনার? দিহানের বন্ধুদের কাছে সে ধর্ষক কী না বা হত্যার উদ্দেশ্য ছিল কী না তা মা হিসেবে জানতে চেয়েছেন? মা হিসেবে তার ছেলেকে আর কে বেশি জানে? আর দিহানের হত্যার উদ্দেশ্য থাকলে তাহলে সে প্রথমেই আনুশকার বাবার কাছে ফোন করত না। আনুশকার বাবা ফোন না ধরলে তার মা ধরেছে। আপনাদের কারো কোনো খবর থাকে না ছেলে মেয়ে কোথায় থাকে, কোথায় যায়, কি খায়? নারী হিসেবে কিশোরীর অসম্মান হোক বা ধর্ষিত হোক সেটা না চাইলে আপনার সন্তানকে নিয়ে সাবধানতা কোথায় ছিল এতদিন? আপনি জানতেন ও একটু আন্দাজ করতে পেরেছেন আপনার ছেলে কোনো একটি সম্পর্কে জড়িয়েছে। মনে হচ্ছে প্রথম দিন সম্পর্ক হয়েছে, দ্বিতীয় দিন আপনি জেনেছেন আর তৃতীয় দিন এ ঘটনা ঘটেছে। বাস্তব হচ্ছে আপনাদের দুটি পরিবার দিনের পর দিন এসব নিয়ে কোনো মাথা ঘামাননি, সম্পর্ক যৌনতা পর্যন্ত গড়াতে বরং সুযোগ করে দিয়েছেন। আপনাদের কাছে এসব মৌজ-মাস্তি আরকি? অবশ্যই দিহানকে নিয়ে আনুশকার কবিতা আপনি উপভোগও করেছেন। আর এখন এ নোংরা ও বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সামাজিক ভাবমূর্তি বাঁচাতে খোলা চিঠি লিখছেন। ফেসবুক আইডিতে দিহানের সাথে ঘনিষ্ঠ ছবি দেখেও সামাল দেয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন মনে করেননি। বিষয়টিকে প্রেম-ট্রেম বা এসব আজকালকার ছেলেমেয়েরা করেই থাকে, আমরাও করেছি বলে কি মনটাকে প্রবোধ দেননি? অথচ বলছেন মা হিসেবে আরও আগে থেকেই একটু আন্দাজ করতে পেরেছি, আমার ছেলে কোনো একটি সম্পর্কে জড়িয়েছে। এবং ধারণা করছেন বাসা থেকে বের হবার পর দিহান মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করলে মেয়েটি বাসায় আসে। বাসা খালি পেলেই প্রেমিকাকে ডাক দিয়ে আনতে হবে কেন? এই শিক্ষাই আপনি দিয়েছেন ছেলেকে? আবার বলছেন দিহানের সাথে বিশ্বস্ততার সম্পর্ক ছিল বিধায় মেয়েটি বাসায় এসেছিল। তাহলে সেই বিশ^স্ততার মূল্য হিসেবে আনুশকাকে জীবন দিতে হল?
আপনি বলছেন, ‘আমি মনে করি ধর্ষণ বা হত্যার উদ্দেশ্যে দিহান মেয়েটিকে বাসায় ডাকেনি। একজন আরেকজনকে ভালোবাসে, সেই হিসেবে একান্তভাবে সময় কাটানোর জন্যই হয়তো ডেকেছিল। উভয়ের বয়স কম, একজন নাবালিকা এবং ছেলেরও বয়স ১৮ বছর ৭ মাস অর্থাৎ কিশোর। আবেগের বসে উভয়েই শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল এবং অপরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে। পরবর্তীতে যা হয়েছে তা নিতান্তই দুর্ঘটনা মনে হচ্ছে। পারভীন শিউলি শিল্পী বিব্রত বোধ করবেন না, এটুকু আপনার জানা যে বয়স কম, আবেগের বসে শারীরিক সম্পর্ক হতে পারে কিন্তু বিকৃত কামাচার হয় না। আর একজন আরেকজনকে ভালবাসা এক জিনিস, বিকৃত কামাচার ভিন্ন। নাবালিকা একটি মেয়ের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয় সে শিক্ষাও আপনি গত ১৮ বছর ৭ মাস দেয়ার সুযোগ পাননি? অপরিপক্কতার পরিচয় দিলে তো অতদূর পর্যন্ত যাওয়ার সাহস পেল কোথায় দিহান? বিকৃত কামাচারের জন্যে যথেষ্ট ও সময় সাপেক্ষ পরিপক্ক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়। দিহানের মনে এই অপসংস্কৃতি চর্চার দুর্বার ইচ্ছা হঠাৎ জন্মেনি। আপনাদের মতো অভিভাবকদের চোখ, কান খোলা না রাখা, সন্তানের প্রতি যথাযথ নজর না দেওয়া এবং বল্গাহীন জীবনযাপন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে অনেকটা বাধ্য করেছে।
আপনার ছেলে ধর্ষক বা হত্যাকারী নয় কিন্তু কোনো ধর্ষক বা হত্যাকারী কি জন্মগতভাবে এমন অপরাধী হয়ে ওঠে। সে নিজে গাড়ি করে আনুশকাকে নিয়ে গেছে, হ্যা গাড়িটির মডেল এক্সিও টয়োটা, যা ছিল তার প্রয়োজন ও বিলাসবহুল জীবনের উপকরণ। কিন্তু তা যে প্রেমিকার লাশ পরিবহনের জন্যে ব্যবহার করতে হবে সেই মর্মান্তিক পরিণতির জন্যে আপনাদের ছেলেমেয়ের প্রতি দায়িত্বহীন আচরণই দায়ী। পুলিশের কাছে ঘটনা স্বীকার করতে সবাই বাধ্য। আর দোষ স্বীকার করলেই কি সব অপরাধ মাফ হয়ে যায়? আবার বলছেন, ‘আমার ছেলে যদি মেয়েটির সাথে অন্যায় করে তাহলে একজন নারী হিসেবে আমিও আমার ছেলের যথাযথ বিচার হোক সেটা চাই।’ তাহলে আপনার এখনো সন্দেহ রয়েছে আপনার ছেলের অপরাধ নিয়ে, কেনো তাহলে ‘যদি’ বলছেন?আরও বলছেন, ‘কিন্তু মেয়েটির ইচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল কিনা এবং একমাত্র শারীরিক সম্পর্কের কারণেই রক্তক্ষরণ ও মৃত্যু হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে পুলিশ প্রশাসনের উপর আমি বিশ্বাস রাখতে চাই এবং বিচার বিভাগের উপর আস্থা রাখতে চাই।’
মনে হয় আনুশকা শারীরিক সম্পর্কের কারণে এক দৌড়ে আপনার বাসায় এসে দিহানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? যতো দোষ মেয়েটির আর ছেলেরা ধোয়া তুলশী পাতা এমন ধারণা এ সমাজে কলঙ্কজনক হয়েই আছে। আর যদি আনুশকার ইচ্ছেতেই হয়ে থাকে তাহলে দিহানের সাত খুন মাফ। কি বলতে চান আপনি, আনুশকার সম্মতি ছিল এ দাবি তুলে আইনী সুবিধা নিতে চান এইতো! আর যে বিচার বিভাগের ওপর আস্থার কথা বলছেন তাতো আপনারই জিইয়ে রেখেছেন, যেখানে টাকা, রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতার কারণে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। প্রতিদিন সকালে পত্রিকার পাতায় নির্যাতিতাদের আর্তনাদ শোনা যায়। এসব আপনাদের স্পর্শ করে না বলেই আপনি বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখেন নাকি আস্থাভাজন হতে চান? আপনার শেষ দাবি, ‘বিচারের আগে আমার ছেলেকে ধর্ষক বা হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত না করার জন্য সমাজের সকলের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।’ আপনার এ অনুরোধ জানানোর আগে সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে আপনার সচেতন হওয়া জরুরি ছিল। কারণ এ ঘটনা সমাজের অনেককে প্রলুব্ধ করতে পারে যেমন এ আশঙ্কা রয়েছে, আনুশকার মতো অনেক মেয়ে এমন ভয়ঙ্করভাবে জীবন খোয়াতে পারে সে আশঙ্কাও রয়েছে।