সুজন কৈরী : [২] রাজধানীর রুপনগর এলাকায় অভিয়ান চালিয়ে নাসিম রিয়েল স্টেটের মালিক ও ৫৫ মামলার গ্রেপ্তারী পরোয়ানাভুক্ত পলাতক আসামি প্রতারক মো. ইমাম হোসেন নাসিমকে (৬০) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৪।
[৩] বুধবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত র্যাব-৪ এর উপ-অধিনায়ক মেজর মো. রকিবুল হাসান এবং সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আক্তারুজ্জমানের নেতৃত্বে একটি দল রুপনগর আবাসিক এলাকায় নাসিমের বাসা ও চিড়িয়াখানা রোডের নাসিম রিয়েল এস্টেটের অফিসে অভিযান চালায়।
[৩] এ সময় একটি ৭ পয়েন্ট ৬৫মি.মি. বিদেশী পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, তিন রাউন্ড গুলি, ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, ১ হাজার ৪০০ পিস ইয়াবা, দুই বোতল বিদেশী মদ, ৪টি ওয়াকিটকি সেট, ৬টি পাসপোর্ট, ৩৭ টি ব্যাংক চেক বহি এবং ৩২টি মোবাইল সিমসহ ৫৫টি গ্রেপ্তারী পরোয়ানাভুক্ত আসামি নাসিম (৬০) ও তার তৃতীয় স্ত্রী হালিমা আক্তার সালমাকে (৩২) গ্রেপ্তার করা হয়।
[৪] নাসিমের উত্থান: র্যাব জানায়, নাসিমের গ্রামের বাড়ি ভোলার দৌলতখানের মেদুয়া গ্রামে। তার বাবা ১৯৫০ সালের দিকে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি ১৯৬০ সালে ঢাকার বাড্ডায় জন্মগ্রহণ করেন। আজিমপুরের একটি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর মিরপুরের একটি হাই স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকার ২টি কলেজ থেকে এইচএসসি ও গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। নাসিম ব্যক্তিগত জীবনে ৩টি বিয়ে করেছেন এবং চার সন্তানের জনক। ১৯৯৬ সালে প্রথম বিয়ে, ২০০৪ সালে দ্বিতীয় এবং ২০১৩ সালে তৃতীয় বিয়ে করেন নাসিম।
[৫] নাসিম ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঠিকাদারির কাজ করে আসলেও মূলত ২০০২ সাল থেকে অভিনবভাবে প্রতারণামূলক কৌশলের মাধ্যমে নিজেকে কথিত নাসিম রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক পরিচয় দিয়ে সাইনবোর্ড টানিয়ে ও ক্ষেত্রবিশেষে অস্ত্র প্রদর্শন করে ভয়ভীতি দেখিয়ে সাভারের কাউন্দিয়া এলাকায় অন্যের জমি, খাস জমি দখল করে আবাসিক শহর গড়ে দেয়ার নামে প্রায় ৫ হাজার সাধারণ জনগণের সঙ্গে বায়না করে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা এবং ২৫০ জনকে ভ‚য়া চুক্তিপত্র করে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে ১২ থেকে ২০ লাখ টাকা আদায় করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
[৬] পাশাপাশি তিনি ২০০৫ হতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে ভিন্ন ভিন্নভাবে মানুষের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। শাহ আলীর চিড়িয়াখানা রোডের ২৫/২৯ নম্বরস্থ’ নাসিম গ্রæপের অফিসে অভিযান চলাকালে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- নাসিম রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, নাসিম ডেভলপার লিমিটেড, নাসিম এগ্রো ফুড লিমিটেড, নাসিম বাজার, এস বি ফাউন্ডেশন, ডা. বেলায়েত হোসেন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, নাসিম পার্সেল ও কুরিয়ার সার্ভিস, সাপ্তাহিক ইমারত অর্থ, নাসিম শিপ বিল্ডার্স, নাসিম ইঞ্জিনিয়ারিং ও কন্সাল্টেন্সি, নাসিম ট্রেডিং লিমিটেড, সাহানা আই হাসপাতাল, বাংলা নিউজ ১৬, নাসিম ড্রিংকিং ওয়াটার, নাসিম রিফাইন্ড সুগার ও নাসিম বেভারেজ।
[৭] আত্মগোপনের কৌশল: র্যাব জানায়, বিভিন্ন সময়ে নামে-বেনামে ৩২টি সিমকার্ড ব্যবহার করে নাসিম সেসব প্রতারণার শিকার মানুষদের ধরা-ছোয়ার বাইরে চলে যেতেন এবং বিভিন্ন সময় অস্ত্র প্রদর্শন ও ওয়াকিটকি দেখিয়ে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন। গ্রেপ্তার এড়াতে আন্ডারগ্রাউন্ডে তার গোপন সুরঙ্গে অবস্থিত ফিঙ্গারপ্রিন্ট সম্বলিত দরজাযুক্ত গোপন অফিসে আত্বগোপন করতেন। নাসিমের অনুপস্থিতিতে তার তৃতীয় স্ত্রী হালিমা আক্তার প্রতারণার ব্যবসা দেখাশোনা করতেন।
[৮] প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছেন, নাসিম অভিনব পন্থা অবলম্বন করে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ জনগণের কাছে প্রতারণামূলক কৌশলের মাধ্যমে নিজেকে বিভিন্ন সময় রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক পরিচয় দিয়ে আবার ক্ষেত্রবিশেষে অস্ত্র প্রদর্শন করে জমি দখলের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। নামে-বেনামে ৩২টি সিমকার্ড ব্যবহার করে সকলের ধরা-ছোয়ার বাহিরে থেকে প্রতারণার কাজ চালাতেন এবং ওয়াকিটকি সেটগুলো দিয়ে নিজের নিরাপত্তা ও রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক হিসেবে তার পরিচয় নিশ্চিত করতেন।
[৯] নাসিম ও হালিমার বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় বিরুদ্ধে প্রতারণা, ভ‚মিদস্যুতা, মাদক ও জালটাকা মামলার প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রেপ্তারী পরোয়ানা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে স্ত্রীর সহযোগীতায় ইয়াবা ও বিদেশী মদ সংগ্রহ করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ডিলার ও খুচরা মাদক কারবারিদের কাছে বিক্রি করছিলেন। এছাড়াও তারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় জাল নোটের ব্যবসা করতেন।
[১০] র্যাব আরও জানান, ভুক্তভোগীরা নাসিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় শতাধিক মামলা করেন। যার প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় প্রতারণা মামলার ৫৫টি গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হয়। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে প্রতারণা সংক্রান্ত অসংখ্য জিডি ও অভিযোগ রয়েছে।
[১১] র্যাব বলছে, গ্রেপ্তার নাসিম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, প্রতারণার অভিযোগে ৪টি মামলা দায়েরের প্রস্ততি চলছে। প্রতারিত অসংখ্য ভুক্তভোগী র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাদের মধ্যে ১০ থেকে ১২ জন প্রতারক নাসিমের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মামলা করতে ইচ্ছুকদের র্যাব-৪ প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :