কামরুল হাসান মামুন : আমার সমস্যা হলো আমি জানি শিক্ষাসহ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কি করা উচিত আর জানি আমরা সেই অবস্থান কতো দূরে। যেটা আমাকে আরো বেশি আহত করে সেটা হলো সেই দূরত্বটা দিন দিন কেবল বেড়েই চলেছে। আমি জানি আমার সমালোচনায় অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে নিজের উপর নিয়ে আহতবোধ করেন। কিন্তু আমি কখনো কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আহত করার উদ্দেশ্যে লিখি না। যেমন আমি যখন লিখি যে, কেবল মাস্টার্স পাস করেই মাস্টার্স পড়ানো উচিত নয়। এতে যারা মাস্টার্স পড়ায় কিন্তু পিএইচডি নেই তারা আহত হতে পারে। কিন্তু আমি তো সিস্টেমের কথা বলছি কোনো একজনকে আহত করার জন্য বলিনি। আমি যখন শিক্ষকদের নিয়োগ ও প্রমোশন নীতির দুর্বলতা নিয়ে লিখি তখনো অনেকে আহতবোধ করতে পারেন। আমি যখন ইনভেলাপ মানি নেয়া কিংবা নিজ কোর্সের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য টাকা নেয়ার বিরুদ্ধে লিখি তখনো অনেকের রাগের কারণ হতে পারি।
আমি যখন শিক্ষকদের সরাসরি দলীয় লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির বিপক্ষে বলি তখনো আমি অনেকের রাগের কারণ হতে পারি। আমি যখন সরকারের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নানা সমালোচনা করি তার মানে আমি সিস্টেমের সমালোচনা করছি। আমি জানি আমার অনেক ছাত্রছাত্রী এখন সরকারি কর্মকর্তা তারা কষ্ট পেতে পারেন, কিন্তু আমি তো দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সিস্টেমের বিরুদ্ধে বলছি। এইটুকু বোঝার মতো জ্ঞানবুদ্ধি নিশ্চয়ই তাদের আছে। আমি যখন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে সমালোচনা করি তখন ওখানে আমার যেই ছাত্রদের মধ্যে অনেকের রাগের কারণ হতে পারি। কিন্তু আমার কথা তো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। আমি যখন শিক্ষকদের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সোচ্চার হই সেটাও সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবেই বলি। আমি যখন কেউ যেকোনো প্রকার অন্যায়ের শিকার হলে তার বিরুদ্ধে বলি। এটাও এজন্য করি না যে, ভিক্টিম আমার খুব প্রিয়। প্রতিবাদ করি কারণ অন্যায়ের প্রতিবাদ করাকে সভ্য কাজ মনে করি বলে।
আমাকে হয়তো এতো প্রতিবাদ এতো বিষয় নিয়ে লিখতে হতো না যদি আমার মতো প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা অনেক হতো। তখন সেই দায়িত্বটা অনেক সহজ হতো। আমি আমার মূল কাজ শিক্ষকতা ও গবেষণায় বেশি মনোনিবেশ করতে পারতাম। এই সমাজে সরকার বা সিস্টেমের প্রশংসা করার মানুষের অভাব নেই, কারণ এটা সহজ কাজ। আর এটা করলে লাভও অনেক। এই সমাজে চুপ করে থাকা বা গা বাঁচিয়ে চলার মানুষের সংখ্যাও অ্যালার্মিংলি বাড়ছে। মনে রাখতে হবে একটি সুন্দর সমাজ গড়তে হলে প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা একটি থ্রেশহোল্ড মানের উপরে থাকতে হয়। ছোটবেলায় দেখেছি কাউকে অন্যায়ভাবে জেলে ঢুকালে প্রতিবাদ হতো। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে প্রতিবাদ হতো। ঘুষখোর দুর্নীতিবাজদের অপছন্দ করতো। এখন এসব উল্টে গেছে। এসব দেখে আগে থেকে বেশি চাকচিক্যের মধ্যে থেকেও সুখে নেই। সুখে থাকবো কীভাবে? খাদ্যে ভেজাল, বাতাসে ভেজাল, পানিতে ভেজাল, পরিবেশে ভেজাল, ঔষধে ভেজাল, মানুষের চরিত্রে ভেজাল। এতো ভেজাল দেখে কে সুখে থাকতে পারে। হ্যাঁ এক জাতীয়রা পারে। তারা হলো যারা ওইসব ভেজাল সৃষ্টিকারীর একজন। ফেসবুক থেকে