ড. এমদাদুল হক : কামদেব অস্তিত্বের সেই অংশ যেখান থেকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। কখনো কখনো শ্রী কৃষ্ণ স্বয়ং দেখা দেন কামরূপে। কামের সঙ্গে অগ্নি যুক্ত হয়ে তা হয়ে যায় কামাগ্নি। তাই কামের অপর নাম অগ্নি।
কামদেবের গায়ে বকুলের ঘ্রাণ, হাতে-অশোক, শ্বেত পদ্ম, নীল পদ্ম, মল্লিকা, আম্রমঞ্জরি শোভিত ইক্ষুনির্মিত ধনুর্বাণ। পঞ্চ পুষ্পময় ধনুর্বাণ পঞ্চশর সজ্জিত। পঞ্চশরের পঞ্চ নাম - সম্মোহন, উন্মাদন, শোষণ, তাপন, স্তম্ভন। পঞ্চশর আবার পঞ্চপুষ্প ভূষিত। পঞ্চপুষ্পের পঞ্চ নাম- অরবিন্দ, অশোক, আম্র, নবমল্লিকা, নীলোৎপল।
মকর তার বাহন। কোকিল, পারাবত, ভ্রমর, বসন্ত, মলয়, বায়ু তার সঙ্গী। উৎসব তার হোলিকা। মৎস্যপুরাণানুসারে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার হৃদয় থেকে জাত তিনি। কালিকা পুরাণানুসারে ব্রহ্মা কামদেবকে সৃষ্টি করে বললেন, ‘দেব, গন্ধর্ব, কিন্নর, সর্প, দৈত্য, দানব, বিদ্যাধর, রাক্ষস, যক্ষ, পিশাচ, ভূত, বিনায়ক, গুহ্যক, সিদ্ধ, মনুষ্য, পশু, পক্ষী, মৃগ, কীট, পতঙ্গ এবং জলজ প্রাণীরা সকলেই তোমার শরের শিকার হবে। অন্য প্রাণী তো বটেই, আমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহাদেবও তোমার বশবর্তী হবো’।
কামদেবের বাণে বশীভূত হয়ে ব্রহ্ম গ্রহণ করেছিলেন শতরূপাকে। ব্রহ্মার চিত্ত মথিত করে তিনি পেলেন ‘মন্মথ’ অভিধা। মহাদেবের দর্প নাশ করে দর্পক ও কন্দর্প হলো তার নাম। তার ক্রোধে ভস্মীভূত হয়ে অঙ্গহীন হয়েছিলেন- তাই তিনি অনঙ্গ। তিনি উদভ্রান্ত তাই নাম হয়েছে কলকেলী। পুষ্প তার পতাকা তাই তিনি পুষ্পকেতন। তিনি সব লোকের মন মত্ত করেন, তাই তার নাম মদন।
অকায়, অতনু, অভিরূপ, অশরীর, অসমবাণ, মকরকেতন, মনোজ, মনোজন্মা, মনোমথন, মার, রম, রমণ, স্মর ইত্যাদি আরো অনেক নাম তার। নাম যাই হোক- কাম তার একটাই- কামভাবের উৎপত্তি ঘটানো।
কামদেব কাম জাগিয়ে দেন। কামশক্তির অত্যল্প অংশই বংশরক্ষার জন্য যথেষ্ট। এই বিশাল উদ্বৃত্ত নিয়ে মানুষ কী করবে, তা কিন্তু কামদেব নির্ধারণ করে দেন না। মানুষ ছাড়া অন্য সব জীবের বেলায় তিনি কাম নিবৃত্তির কাল, উপায়, স্থায়িত্ব, আসন, শৃঙ্গার সবকিছু নির্ধারণ করে দিলেন, অথচ মানুষের বেলায় কিছুই নির্ধারণ করে দিলেন না কেন?
মনুষ্যের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, পেশা, নাম, কাম, ধাম কোনো কিছুই নির্ধারিত নয়। মানুষের চিন্তা করার জন্য মস্তিষ্ক আছে, কাজ করার জন্য হাত আছে, আছে উদর উপস্থ। যা দেবার ছিলো, যতোটুকু দেবার ছিলো, পরমাপ্রকৃতি তা দিয়ে দিয়েছেন। এবার মানুষই সিদ্ধান্ত নিক, সে কী খাবে, কোন পথে চলবে, কী করবে তার উদ্বৃত্ত নিয়ে।
তিনি খেলার সরঞ্জামাদি দিয়ে দিয়েছেন, এখন খেলা দেখছেন। কে কীভাবে খেলে, তা দেখাই তার আনন্দ। মানুষের হাত আছে, বানরেরও হাত আছে। মানুষ হাত দিয়ে বাগান করে, ছবি আঁকে, কবিতা লেখে, বেহালা বাজায়। পশুর পেট আছে- মানুষেরও পেট আছে। পশু জানে কী খাবে, কখন খাবে, কতোটুকু খাবে। মানুষ জানে না, জানলেও মানুষ ভুলে যায়। প্রেমের ব্যাকুলতায় মানুষ খেতে ভুলে যায়, আনন্দের সময় ভয় ভুলে যায়। জীবজন্তুরা মাতা-পিতাকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না। মানবশিশু কথা বলতে শুরুই করে প্রশ্ন দিয়ে। শিশু চাঁদের দিকে তাকায়, আর বিস্ময়ে প্রশ্ন করে, ‘বাবা, চাঁদ কতো দূরে? কে তাকে ধরে রেখেছে’?
শিশুর প্রশ্নগুলোকে যদি রুদ্ধ করা না হতো, শিশুমনে যদি পুলিশের ভয়, সম্পদের লোভ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও কামসভ্যতা ঢুকিয়ে না দেয়া হতো, তাহলে কী হতো? মানুষ কী তার প্রশ্নগুলো নিয়ে সত্যের নিকটবর্তী হতো? সূর্যমুখী যেমন আলোমুখী হয়, মানুষও কী তেমনি প্রকৃতির নিয়মে জ্ঞানমুখী হতো?
মানুষের বুদ্ধি যদি নৈতিক বিধান, সামাজিক রীতি-নীতি ও প্রথা দ্বারা বদ্ধ না হতো, তাহলে কী হতো? কেমন হতো মানুষের কামসূত্র?
পরমাপ্রকৃতি মানুষকে চয়ন করার যে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন সমাজ সেই স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। এখন গ-ারের স্বাধীনতাও মানুষ থেকে বেশি। মানুষ বই পড়ছে, জানছে- কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে জানার আনন্দ। মানুষকে শেখানো হচ্ছে- মানুষ শিখছেও কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে শেখার আনন্দ। মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি শেখানো হয় না, মানুষকে শেখানো হয় সিদ্ধান্ত। মানুষ নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। আনুগত্য করে অন্যের নেয়া সিদ্ধান্তের। সিদ্ধান্তের আনুগত্য থেকে ‘মাছি মারার কেরানি হয়’- জ্ঞানের উদয় হয় না। আমরা শাস্ত্রের সিদ্ধান্তগুলো মুখস্থ করাই, আর ভাবি, শিক্ষিত মানুষগুলো এতো মূর্খ কেন? কাষ্ঠমোল্লারা দ্বন্দ্বে লিপ্ত কেন?
প্রকৃতি পশুকে মানুষ হবার সুযোগ দেয়নি, কিন্তু মানুষকে পশু ও ঈশ্বর হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। হিটলার হওয়ার দুর্যোগটি এখনও আওলাদবাদীদের জন্য উন্মুক্ত আছে। কিন্তু বুদ্ধ হওয়ার সুযোগটি একেবারেই গেছে। একেই বলে কলিকাল- বুদ্ধের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে বুদ্ধবাদীরাই হয়ে উঠেছে চরম বুদ্ধবিরোধী।
কীভাবে মানুষ শিখবে যদি তার মগজ পূর্ণ করে দেয়া হয় মতবাদ দিয়ে? না জানাকেই যে জানা ভাবছে তাকে জানানোর সাধ্য কার? ফেসবুক থেকে