অসীম সাহা : ১৯৮৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি। মহান শিল্পী কামরুল হাসানের প্রয়াণ দিবস। ১৯৮৮-এর এই দিনে জাতীয় কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান। তিনি নিজেকে চিত্রশিল্পী হিশেবে পরিচয় দেয়ার চেয়ে ‘পটুয়া’ হিশেবে পরিচয় দিতে বেশি গৌরববোধ করতেন। কারণ দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর ছিলো আত্মার যোগ। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষদের নিয়ে ছবি আঁকতে বিশেষত স্কেচ করতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। মাটির পটে চিত্র আঁকায় কুমোরদের যে দক্ষতা, তার প্রতি কামরুল হাসানের ছিলো গভীর মনোযোগ।
শহুরে শিল্পী হয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তিনি নানা ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এদেশে ‘ব্রতচারী’ খেলার প্রচলনে কামরুল হাসানের অবদান একক ও অদ্বিতীয়। সেই অমর শিল্পী কামরুল হাসান এরশাদ সরকারের স্বৈরাচারী শাসনকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় কবিতা পরিষদের মঞ্চে বসেই লিখেছিলেন সেই অমোঘ বাণী ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’। কথাটি লেখার পর পরই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মঞ্চের ওপরই ঢলে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
এই কিবংবদন্তি শিল্পীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার তিনজিলা গোরস্তান রোডে। তাঁর পৈতৃক নিবাস বর্ধমানের নারেঙ্গ গ্রামে। তাঁর বাবা মুহাম্মদ হাসিম ছিলেন একটি স্থানীয় গোরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক। কামরল হাসানের পড়াশোনা কলকাতা মডেল এমই স্কুল, কলকাতা মাদরাসা এবং পরবর্তীকালে কলকাতা ইনস্টিটিউট অফ আর্টসে। ১৯৪৭ সালে তিনি ফাইন আর্টসে পাস করেন। ড্রইং-এ দক্ষতা অর্জন করে তিনি বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়ান। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার মুখের ছবি দিয়ে আঁকা ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ পোস্টারটি তাঁকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়।
ভারত বিভাগের পর কামরুল হাসান ঢাকাতে আসেন। ১৯৪৮ সালে জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে একত্রে গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অফ ফাইন আর্টস (বর্তমানে, ফ্যাকাল্টি অফ ফাইন আর্টস) প্রতিষ্ঠা করেন। রাজনৈতিকভাবে প্রগতিশীল কামরুল হাসান অনেক রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও রেডিও-র কলা বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে শিবনারায়ণ দাশ কর্তৃক ডিজাইনকৃত জাতীয় পতাকার রূপ বদল করে তিনি বর্তমান রূপ দেন।
জীবিকাসূত্রে তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ ক্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেন এবং ১৯৬০ থেকে ১৯৭৮ সালে পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার নকশা-কেন্দ্রের পরিচালক হিশেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগের শিল্পবিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
শিল্পচর্চায় অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও তিনি নানা ধরনের সম্মানে ভূষিত হন। দেশে-বিদেশে তিনি বহু একক এবং যৌথ চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ-সংলগ্ন গোরস্থানে এই মহিমান্বিত শিল্পী কামরুল হাসানকে সমাহিত করা হয়।
আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে এই মহান শিল্পীর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : কবি ও সংযুক্ত সম্পাদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়
আপনার মতামত লিখুন :