কামাল হোসেন শাহীন : রুইলুই পাহাড়ের বুক চিরে চান্দের গাড়ি সামনে চলে। লোকজনের বেশ আনাগোনা। সমতলের মানুষ পাহাড়ে এসে নিজেদের মত সময় কাঁটায়। আদিবাসীদের আবাসে বাংগালীদের অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাই। সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে নির্মিত পীচের রাস্তার সাথে বিজিবি ক্যাম্প, হেলিপ্যাড পেরিয়ে ইটের তৈরী যেনতেন রাস্তা। শরীর বেশ টের পাচ্ছে কিন্তু মন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে গন্তব্যের শেষ সীমারেখার দিকে। পাহাড়ের মাঝে চোখ ছুটে চলে দুরের সবুজ অরণ্যে। কিছুদুর গিয়ে কাঁচা রাস্তা। গতরাতের বৃষ্টি রাস্তাটিকে বেশ অকেজো করে দিয়েছে। গাড়ি গিয়ে থামে টঙঘরের সামনে।
সামনে বেশ কিছুদূর হেঁটে কংলাক যেতে হবে ভেবে বাহিরটা গুটিয়ে আসলেও ভেতরটা ছটফট করছিল উচ্ছ্বাসে। দুটি আদিবাসী বাচ্চা বিক্রির জন্য লাঠি নিয়ে বসে আছে। অনেকগুলো বাঁশের লাঠি। সেই পুরানো চর দখলকারী লাঠিয়াল বাহিনী এমন লাঠি দিয়েই নিজেদের রক্ষা করত। লাঠির সরু প্রান্তে সুন্দর করে কাটা। হাতে নিয়ে বহন করা বেশ সহজ। দাম জিজ্ঞাস করাতে জানাল প্রতিটি দশ টাকা। তাদের দশ, পাঁচ টাকার উচ্চারণ কানে বাজে। অনেকটা অপ্রয়োজনীয় মনে করেই লাঠি হাতে নিয়ে যাত্রা শুরু করি। তখনও লাঠির গুণাবলির বিষয়ে অনেকাংশই অজ্ঞাত।
হাতে লাঠি, কাঁধে ব্যাগ! মাটিতে ঠেক দিয়ে আমরা বেশ সাচ্ছন্দ্যে এগুতে থাকি। আমরা ধীরে ধীরে উপর থেকে অারো উপরে উঠছি। হাতের লাঠি পরমবন্ধুর মতো আমাদের সঙ্গী হলো। বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর মাথা উঁচিয়ে ডান দিকে তাকাতেই উপরে নজরে আসে আমাদের লক্ষ্যস্থল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আমরা এগিয়ে চলি মেঠোপথের আদলে পাথুরে পথে। আমাদের ডান পাশে উচু পাহাড় আর বায়ে অনেক নিচে পাহাড়ের পর পাহাড়। সবুজের চাদরের মাঝে ছোট ছোট ঘর প্রাণের জানান দিচ্ছে। আমরা লাঠিতে ভর করে হাঁটছি। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, এ যেন পিছনে ফেলে আসা দীর্ঘ পথচলার প্রমান। হাতে লাঠি আর পিছনে ব্যাগ, ঘর্মাক্ত চেহারা যেন সেই বৃদ্ধের মত, যে কিনা বাড়ির দরজায় এসে আল্লাহ করিমমমম.... বলে হাক দেয়। শেষ পথটুকুতে পা যেন চলছেই না। সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠার মত পথ।
উপরে উঠে দেখি পাহাড়ের চুঁড়ায় অল্প কয়েকটি কাঠের পাটাতনের উপর দৃষ্টিনন্দন টিনের রঙ্গীন ঘর। টিনের চালার নিচে বাঁশ কাঠে নির্মিত ঘরগুলোতে আভিজাত্যের কমতি নেই। বেশ ফাঁকা জায়গা চারপাশে। ঘরগুলো পাহাড়ের পুর্বপাশ নিয়ে,নির্মানের সময় হয়তো চেষ্টা ছিল যতটুকু পাহাড়ের ঢালে যাওয়া যায়। রিসোর্টের মালিক বিজু ভাই আর মৌসুমী ভাবী যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বছর চারেক আগে বিজু ভাই এখানে পাহাড় কেটে রিসোর্ট করতে গেলে স্থানীয়রা বলেছিল, ঢাকা থেকে এক বাংগালী পাগল এসেছে পাহাড় কেটে রিসোর্ট করতে। পরে বহু দেনদরবার করে একসময় পর্যটকদেরও রক হিল প্যারাডাইস এ আসা ও থাকার অনুমতি মিলে।
রুমে ঢুকে চোখ ছানাবড়া। কাঠের পাটাতনের উপর তৈরি ঘরে পাশাপাশি দুটি বিছানায় চারজনের থাকার ব্যবস্থা।বেশ পরিপাটি করে সাজানো রুম।রুমের সাথে লাগোয়া বেশ সুন্দর একটা ওয়াশরুম। পূর্বে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে উত্তর- দক্ষিনে বিশাল খোলা বারান্দা। নিচে দিকে পাহাড়ের ঢালে দুটি ঘর। এক কামড়ার ঘরে সবাই মিলে জীবন ধারন করছে আদিবাসী লোকজন। ঘরের মাচাংএ থাকা ছোট ছেলের সাথে চিৎকার করে সামান্য বাক্যালাপ করি। নারী সদস্যটি কাঁধে পানি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশের ঝর্না থেকে পানি নিয়ে ফিরছে। পূর্বে পাহাড়ের পর পাহাড়। সবুজাভ অরণ্য পেরিয়ে অল্প দূরে মিজোরাম। দৃষ্টি সীমানা পেরিয়েও সবুজ আর সবুজ। উত্তরে আমাদের সবুজ পাহাড় পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরা।
বারান্দার কাঠের পাটাতনে পুর্ব দিকে তাকিয়ে বেশ কিছু সময় আড্ডা। চোখ খুঁজে ফিরে পাহাড়ে সবুজ অরণ্যে দেশের সীমা ছাড়িয়ে আরো দূরে। অনেকদূর পাহাড়ের কোনে ঘরবাড়ি যা কিনা আমাদের গ্রামাঞ্চলে মুরগীর খোপের ন্যায়। খবর আসে খাওয়া প্রায় রেডি। আমরা যেন তৈরি হয়ে চলে আসি। বিজু ভাই বিনয়ের সাথে পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ীতার কথা বলেন। পানি সরবরাহের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় আদিবাসী মহিলাদের কাঁধে করে পানি আনা হয়। পানি ব্যবহার করতে গিয়ে দেখি, বরফগলা পানি ইচ্ছে করলেও বেশি ব্যবহার করা যায় না।
আগেই খাবারের অর্ডার আগেই দেয়া ছিল, এটাই এখানকার নিয়ম। রক প্যারাডাইস এর খাবার ঘরটিও থাকার ঘরের মত পাহাড়ের পুর্ব প্রান্তে। পাহাড়ী চালের অর্ধ গলিত ভাতের সাথে ভর্তা, সবজি, মুরগীর মাংস আর ডাল চমৎকার রসনা সরবরাহ করেছিল। সারাদিনের কর্মব্যস্ত সময়ে এমন খাবার পেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠি। এখানে মাছের প্রত্যাশা করা দুরাশা কারন ৭০ কিমি দূর থেকে আসা কাঁচা মাছ কিছুতেই পাহাড়ে এনে পরিবেশন সম্ভব নয়। সবশেষে এক কাপ আদা চা শরীর ও মনে এক অন্যরকম প্রশান্তি এনে দিল।
রুমে ফিরে পাহাড়ের ভিউ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পরি। মানুষের কোলাহল আর রিসোর্টের লোকজনের ডাকাডাকিতে যখন ঘুম ভাংগে তখন প্রায় শেষ বিকাল। তাকিয়ে দেখি, সবুজের উপর যেন কুয়াশা জমে ভিন্ন রূপ ধারন করেছে যা দুপুরের ভিউ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেড়িয়ে পরি। একটু উত্তরে গিয়ে উপরে উঠে দেখি অসংখ্য পর্যটক পাহাড়ে সুর্যাস্ত দেখতে অপেক্ষা করছে। পুর্ব পাশের ভিউ থেকে পশ্চিম পাশের ভিউ আলাদা। একস্থান থেকেই চারপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য যেকোন মানুষকেই বিমোহিত করে। পাহাড়ের কোলে সূর্য চলে যায় আপন আলোয়। আলো আঁধারে পাহাড়ের এ দৃশ্য শুধুই উপভোগ্যের, বর্ণনার নয়।
আকাশের মেঘ যেন পাহাড়ে ভর করেছে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। দুপুরের সবুজ পাহাড় সাদা শাড়ি পরা শুরু করেছে। বিদ্যুৎ চমকানো পাহাড় থেকে পর্যটকগন চলে গেছে রুইলুইর দিকে। কংলাক থেকে রুইলুইর আলো স্পস্ট দেখা যায় । সেখানে নাকি রাতের বেলা পাহাড়ের বুকে নগর বসে। পর্যটকদের হাটে না গেলে নাকি অপূর্ণ থেকে যাবে অনেক কিছু! রুইলুই পাড়া আমাদের যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পাহাড়ে বৃষ্টি আর মেঘ বিলাসের প্রত্যাশায় থমথমে পরিবেশে। এরই মধ্যে আমরা কাপ কফি খেয়ে নামার প্রস্তুতি নিই। আবারও চারজনের হাতেই লাঠি। অন্ধকার পাহাড়ি পথে পলিথিনে মোড়ানো মোবাইল ফোনের আলোকেই সঙ্গী করে পা বাড়াই। হঠাৎ করে জুয়েল ও পারভেজ চেঁচিয়ে ওঠে সাপপপপ.....