আরটিএনএন: ৯২ বছর বয়সে সবাই যখন অবসর ভোগ করেন। মালয়েশিয়ার প্রবীণ নেতা মাহাথির মোহাম্মদ করেছেন উল্টোটা। তিনি ফিরেছেন নির্বাচনী প্রচারাভিযানে।
বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কেলেঙ্কারিতে বিধ্বস্ত প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে। তবে ৬ দশক ধরে মালয়েশিয়া শাসন করা জোট সরকারের বিরুদ্ধে তার জয়ের সম্ভাবনা কম।
এর পরও অঘটন ঘটিয়ে যদি তিনি নিজের সাবেক শিষ্য নাজিব রাজাককে হটিয়ে বিজয়ী হয়েই যান, তবে তিনিই হবেন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রধানমন্ত্রী। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
তাকে বলা হয় আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার। তার রাষ্ট্র পরিচালনা এবং উন্নয়নের মন্ত্র কেবল নিজের দেশের ক্ষেত্রেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই রোলমডেল হিসেবে স্বীকৃত। এমনি আদর্শিক চেতনা নিয়ে দারিদ্র্যের তলানীতে অবস্থান করা মালয়েশিয়াকে তুলে এনেছেন উন্নয়ন আর আধুনিকতার শীর্ষে।খবরে বলা হয়, ২২ বছর ধরে শক্ত হাতে মালয়েশিয়া শাসন করেছিলেন মাহাথির। তবে রাজনীতির পহেলা সারিতে মাহাথিরের প্রত্যাবর্তনকে বেশ নাটকীয়ই বলা চলে।
আরো পড়ুন : চলতি মাসে প্রজ্ঞাপন না হলে আবারো আন্দোলন
বেশি দিন হয়নি প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিল ১এমডিবি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। আর তাতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান মাহাথির। এর মাধ্যমেই যেন রাজনীতিতে পুনর্জন্ম হলো তার। তবে তার এই রাজনৈতিক ‘ডিগবাজি’ কয়েক বছর আগেও অচিন্তনীয় ছিল। তিনি বিরোধী শিবিরে যোগ দিয়ে সেসব দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন যাদের তিনি শাসক থাকাকালে দমন করেছেন। অপরদিকে যে দলের নেতৃত্বে ছিলেন বহু বছর, সেই দলের বিরুদ্ধেই প্রার্থী হয়েছেন। বিরোধী পক্ষের জন্যও মাহাথিরকে প্রার্থী করা বাজি ধরার সমতুল্য। কারণ, দেশটিতে তিনি আর ঐক্যের প্রতীক নন। কেউ পছন্দ করেন, কেউ করেন না।
মুসলিম মালয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অগ্রদূত ও আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক হিসেবে অনেকে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার তখনকার দরিদ্র্য দেশকে তুলনামূলক সম্পদশালী দেশে পরিণত করার নেপথ্যে তাকে প্রায়ই কৃতিত্ব দেয়া হয়। তবে তিনি অনেকের কাছে একনায়ক হিসেবে পরিচিত, যিনি কি না মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করে বিচার বিভাগকে অবজ্ঞা করেছেন, বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জেলে পুরেছেন। পাশাপাশি, বহু সম্প্রদায়ের দেশটিতে তার বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে জাতিগত বিভেদও বেড়েছিল।
আরো পড়ুন : তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা
প্রতিপক্ষদের ব্যাপারে খুবই ধারালো বক্তব্য ব্যবহার করেন তিনি। কথিত পশ্চিমা নও-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তিনি কড়া ভাষায় কথা বলতেন। একবার তিনি ইউরোপিয়ানদেরকে বলেছিলেন, লোভী, যুদ্ধপ্রিয় যৌনবিপথগামী হিসেবে। নেতা হিসেবে মাহাথিরের কিছু দুর্বলতা থাকলেও ‘আশার জোট’ বলে পরিচিত বিরোধী শিবির মনে করে, প্রত্যন্ত মালয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এখনও তার সংযোগ রয়েছে। এ কারণে নির্বাচনে তিনিই হবেন তুরুপের তাস। শুক্রবার সংসদ ভেঙে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নাজিব। আগামী নির্বাচন সপ্তাহ কয়েকের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। বিরোধী দলগুলোর প্রত্যাশা, মাহাথিরের কারণে শাসক জোট বারিসান নাশনালের কিছু মালয় ভোট তারা পাবে। এই ভোট বিরোধী জোটের সমর্থক, যেমন, শহুরে ভোটার ও সংখ্যালঘু (বিশেষ করে জাতিগত চীনা) ভোটের সঙ্গে যোগ হলে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।
বেসরকারি নির্বাচনী প্রতিষ্ঠান মার্দেকা সেন্টারের প্রধান ইব্রাহিম সুফিয়ান বলেন, ‘মাহাথিরকে জোটে নিয়ে বিরোধী দল কিছু মালয় সমর্থন ঘরে তুলবে। প্রশ্নটা হলো, কতটা? তবে আমি মনে করি, তারা অত সাফল্য পাবে না।’ ক্ষমতার ওপর সরকারি দল বিএন’র নিয়ন্ত্রণকে সংহত বলা চলে। এছাড়া সমালোচকরা মনে করেন, নির্বাচনী সীমানা পুনঃনির্ধারণের এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ক্ষমতার ভারকেন্দ্র ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ঠেলে দেবে। ফলে পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হবে বিরোধী শিবিরের জন্য।
মাহাথিরের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো তারই সাবেক রাজনৈতিক চিরশত্রু আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে তার সবকিছু মিটমাট হয়ে যাওয়াটা। ১৯৯৮ সালে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জেরে আনোয়ারকে দল থেকে বহিষ্কার করেন মাহাথির। বহিষ্কারের আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন মাহাথিরের রাজনৈতিক উত্তরসূরি। বহিষ্কারের পর তাকে সমকামিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে কারান্তরীণ করা হয়। ৬ বছর জেল খেটে আনোয়ার যখন মুক্তি পান, তখন তার নেতৃত্বে ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিরোধী জোট তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো ফল করে। তবে ২০১৫ সালে ফের নাজিব রাজাকের সরকার তাকে জেলে ঢুকায়। মাহাথির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে আনোয়ার মুক্তি পাওয়ার পর তার হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
আরো পড়ুন : তারেকের নাগরিকত্ব না থাকলেও দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে : আইনমন্ত্রী
মূলত, প্রধানমন্ত্রী রাজাকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিল ১এমডিবি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠলে অবসর ভেঙে সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরার ঘোষণা দেন মাহাথির। রাজাকই ওই তহবিল গঠন করেছিলেন। তার দাবি, তিনি কোনো অন্যায় করেননি। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে মাহাথির ছিলেন পেশায় একজন ডাক্তার। তাকে এখনও ডাক্তার এম বলে ডাকা হয়।
১৯৬৪ সালে মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের সংসদ সদস্য হয়ে তার রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৯৮১ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
মাহাথির ১৯৭১ সালে প্রনিত নিউ ইকোনমিক পলিসি (এনইপি) সফল ভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। এনইপির উদ্দেশ্য ছিল জাতি নির্বিশেষে দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে জাতি পরিচয় মুছে ফেলা। নতুন সম্পদ সৃষ্টি করা এবং এর বৃহত্তর অংশ দরিদ্রদের জন্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে সম্পদের পুনঃবন্টনের চেষ্টা করা হয়। ১৯৯০ সালে মালয়েশিয়া বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৮% ছাড়িয়ে যায়।
আরো পড়ুন : সচিব হলেন ৩ কর্মকর্তা
১৯৯১ সালে বিশ বছর মেয়াদি এনইপি শেষ হয়। দারিদ্র্য বিমোচন বহুলাংশে অর্জিত হয়। সমৃদ্ধির একটি পর্যায়ে পৌছে মালয়েশিয়া বিভিন্ন জাতির সুসম্পর্কসহ একটি জাতিতে পরিণত হয় যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য ঈর্ষনীয়। বিশ বছর মেয়াদি এনইপি শেষ হবার পর দশ বছর মেয়াদি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি (এনডিপি) প্রনয়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই ৫৫ বছর বয়সে ডা. মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটানা ২২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ৭৭ বছর বয়সে ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ও রাজনীতি থেকে বিদায় নেন।
আপনার মতামত লিখুন :