শিরোনাম
◈ সাবেক মন্ত্রীর চার ছেলের দেশত্যাগে আদালতের নিষেধাজ্ঞা ◈ ১৩০ জনের মনোনয়ন প্রত্যাহার ◈ এসএসসির ফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন শুরু সোমবার ◈ প্রবীণ রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনোর দাফন সোমবার ◈ লু’র সফরে আগ্রহ নেই বিএনপির, বৈঠকও হবে না ◈ ভারতে মুসলিমদের সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে মোদী সরকারের বিতর্কিত প্রতিবেদন ◈ আওয়ামী সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে নয়াপল্টনে ককটেল বিস্ফোরণের নাটক সাজানো হয়েছে: রিজভী ◈ সরকারি চাকুরির বয়সসীমা ৩৫ চেয়ে আন্দোলনে গ্রেপ্তার ১২ শিক্ষার্থীর জামিন ◈ স্মার্ট হলো হজযাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধন রিফান্ড প্রক্রিয়া ◈ জি এম কাদেরই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান: আপিল বিভাগ

প্রকাশিত : ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:১২ দুপুর
আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:১২ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

দারিদ্র্যকে জয় করা কৃষ্ণা রাণীর ফুটবল রাজকন্যা হয়ে উঠার গল্প

সাইফুল ইসলাম, টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা শহর থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত একটি গ্রামের নাম উত্তর পাথালিয়া। প্রত্যন্ত এই গ্রামে প্রবেশ করার আগে পশ্চিমে ঝিনাই নদী আর পূর্বে বিস্তীর্ণ ডগাবিল।

গ্রাম ভেদ করে চলে যাওয়া মুশুদ্দী-ঝাওয়াইল সড়কের প্রাচীন এক বটবৃক্ষ বাঁয়ে রেখে একশগজ সামনে এগুলেই দারিদ্রতার ছাঁপে জর্জরিত একটি টিনের বাড়ি। অচল পয়সার মতো অবহেলার ছোট এই টিনের বাড়িটি ঘিরেই এখন পাথালিয়া গ্রামের ছোট বড় সকলের পাশাপাশি উপজেলাসহ টাঙ্গাইল জেলাবাসীর গর্ব আর ব্যাপক উচ্ছ্বাস।

গর্ব আর উচ্ছ্বাস হবেই না কেন! কারণ এ বাড়িটিইতো বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলকে নতুন করে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা দলের অধিনায়ক এবং দলের অন্যতম বড় ভরসার নাম কৃষ্ণা রাণী সরকারের। একটি অঁজপাড়া গাঁয়ে কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা কৃষ্ণার সাফল্যে সারাদেশবাসীর কাছে সত্যিই অনেক প্রশংসনীয় এবং আনন্দের। কৃষ্ণা শুধু অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা দলের অধিনায়কই নয়। একই সঙ্গে দলের একজন
নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ডও বটে।

ছোটবেলা থেকেই খেলাপাগল কৃষ্ণার ভিন্নমাত্রার আকর্ষণ ছিল ফুটবলের প্রতি। সারাক্ষণ কাকাতো ভাইদের সাথে আর গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ছেলেদের সঙ্গে মিলে ফুটবল খেলতো কৃষ্ণা। দিনের বেশির ভাগ সময় খেলা নিয়ে বাড়ির বাইরে থাকতো বলে মা প্রায়ই বকা দিতেন এ তুখোড় কিশোরী।

পাড়াপড়শীরাও টিপ্পনী কাটতো তাকে। লেখাপড়ার প্রতি কিছুটা অমনোযোগী থেকে ফুটবল নিয়ে মাতামাতি করায় একবার কৃষ্ণার মা হাত থেকে বল কেড়ে নিয়ে বলটি বঁটি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে চুলোয় দিয়েছিলেন। তা দেখে কৃষ্ণার কাকা পরে একটি ফুটবল কিনে দেন তাকে। এক পর্যায়ে ছেলেদের সঙ্গে মিলে ফুটবল খেলা বন্ধ করে দিলে কৃষ্ণা খাওদায়াওয়া ছেড়ে দেয়। পরে আশপাশের মেয়েশিশুদের নিয়ে বাড়ির ছোট আঙ্গিনায় ফুটবল চর্চার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু তাতেও কৃষ্ণাকে দমাতে পারেননি বাবা বাসুদেব চন্দ্র সরকার ও মা নমিতা রাণী সরকার।

এদিকে ফুটবলে কৃষ্ণার হাতেখড়ি ২০১০ সালে উপজেলা পর্যায়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুনেচ্ছা মুজিব আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবল টুর্নামেন্টে। কৃষ্ণার নেতৃত্বে তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তর পাথালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজেলা পর্যায়ে চ্যা¤িপয়ন হয়। ওই টুর্নামেন্টে কৃষ্ণা সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ায় সূতী ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের নজরে পড়েন এ ফুটবল রাজকন্যা।

ফুটবলে কৃষ্ণার অসাধারণ ক্রীড়া নৈপূণ্য দেখে ওই শরীর চর্চা শিক্ষক অনেকটাই নিজের আগ্রহ নিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে কৃষ্ণার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর কৃষ্ণাকে সূতী ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুলে বিনাবেতনে ভর্তি করানো হয়। আর এ স্কুলে ভর্তি হয়েই ফুটবল চর্চার অবাধ সুযোগও পেয়ে যায় টাঙ্গাইলের এ কৃতী ফুটবল কন্যার।

কৃষ্ণার ফুটবলার হওয়ার পেছনে তার কাকার বেশ অবদান রয়েছে। সকালে ঘুম থেকে তুলে বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন তার কাকা। কৃষ্ণার বাবার কাছে তেমন একটা টাকা ছিল না। তাই আসা-যাওয়ার ভাড়াটাও ওই কাকাই দিতেন। এরপর উপজেলা পরিষদ থেকে সাইকেল দেওয়ার পর অনুশীলনে যেতে তেমন একটা সমস্যা হয়নি।

একসময় দরজির দোকান ছিল কৃষ্ণার বাবার বাসুদেব সরকারের। টাকার অভাবে অনেক আগেই দোকানটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন দারিদ্র্যকে জয় করা কৃষ্ণার হত দরিদ বাবা। বর্তমানে অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে দিনাতিপাত করছেন তিনি।

পরে গোলপুরের সূতী ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুল কৃষ্ণার ফুটবল নৈপূণ্য আর বিশেষ ভূমিকায় জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে পর পর তিনবার জাতীয় চ্যা¤িপয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পরবর্তীতে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দল গঠন করা হলে কৃষ্ণাসহ একই স্কুল থেকে আরো দুই কিশোরী ফুটবলার বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দলেও জায়গা করে নেন।

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক ফুটবলে কৃষ্ণার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। পরের বছর একই টুর্নামেন্টেও শিরোপা ঘরে তোলে বাংলাদেশ। তবে সেই দলে বয়সের কারণে ছিলেন না কৃষ্ণা। কিন্তু একই বছর ঢাকায় হওয়া এএফসসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বে চ্যা¤িপয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই দলের গর্বিত অধিনায়কও ছিলেন কৃষ্ণা রাণী সরকার। একই সঙ্গে সেই আসরে ৮ গোল করে দলকে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন এ ফুটবল বিস্ময় কন্যা। ২০১৭ সালে কৃষ্ণার নেতৃত্বেই থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের মূল পর্বে খেলার গৌরব অর্জন করেছে লাল-সবুজের দল। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ভারতে হওয়া সাফ ফুটবলে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ। যে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন কৃষ্ণা।

সারা বছর ঢাকায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ক্যা¤েপই এখন কাটাতে হয় তাকে। মাঝে মধ্যে ছুটিতে বাড়ি আসেন। ক’দিন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ বালিকা সাফ শিরোপা জিতেছে। বয়সের কারণে সেই দলে অবশ্য ছিলেন না কৃষ্ণা। তবে অনুজদের এই সাফল্যের ভাগিদার তারাও। মূলত তাদের পথ ধরেই তো এসেছে এই অসাধারণ ও নান্দনিক ক্রীড়া সাফল্য। বাংলাদেশের মেয়েরা অনূর্ধ্ব-১৫ সাফের শিরোপা জেতার পরই ছুটিতে বাড়ি এসেছেন কৃষ্ণা। এমন সময় সরেজমিনে তার স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, কৃষ্ণা তার স্কুলের অন্যান্য বন্ধুদের সাথে খেলাধূলা করছেন। এমনকি অনেক শিক্ষার্থী সুযোগ পেলে কৃষ্ণার কাছ থেকে হাসি খুশি মুখেই সেই অটোগ্রাফের আবদারও মিটাচ্ছেন।

নিজের ফুটবলার হওয়ার নানা বিষয়ে কৃষ্ণা রানী বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই আমার ফুটবল খেলার প্রতি তুমুল আগ্রহ ছিল। আমি নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ফুটবল খেলেছি। এক পর্যায়ে আমার সাফল্যও এসেছে। আগে আমাকে অনেকেই নানান কথা বলেতা, কিন্তু এখন আর আমাকে তা বলে না। আমার দেখাদেখি আমাদের ক্যা¤েপ এখন অনেকে ভালো ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন বুনছেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান কৃষ্ণা।

পাশাপাশি তার এ চমকপ্রদ সাফল্যে স্কুলের কৃতিত্বের কথাও স্মরণ করতে ভোলেননি কৃষ্ণা। কৃষ্ণা বলেন, আমার এই সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমার প্রাণের স্কুলের। কৃষ্ণা আরো যোগ করেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে সহযোগিতা না করলে আমি আজ সেরা ফুটবলার হতে পারতাম না।’

এ কিশোরী ফুটবলার আরো বলেন, আমার বাবা একজন কৃষক। আমি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও একজন ভালো মানের ফুটবলার হওয়া যায়। যদি এতে নিজের প্রবল আগ্রহ থাকে। বর্তমানে কোনো অংশেই নারীরা পুরুষ থেকে পিছিয়ে নেই। এ ফুটবল রাণী বলেন, ‘নারী ফুটবলে বিগত বছরগুলোতে আমাদের ব্যাপক সাফল্য এসেছে। আশা করছি নতুন বছরেও আমাদের সাফল্য আসবে।

সামনে আমাদের অনেকগুলো আন্তর্জাতিক আসর রয়েছে। আশা করছি আমরা এ টুর্নামেন্টে সফল হবো।’
সূতি ভিএম মডেল পাইলট হাইস্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপন এ প্রতিবেদককে বলেন, কৃষ্ণা খুব দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কঠোর পরিশ্রম এবং ইচ্ছা শক্তি থাকার ফলে কৃষ্ণা আজ দেশ সেরা ফুটবলার হতে পেরেছে। যা সত্যিই প্রশংসনার দাবী রাখে। তাকে দেখে স্কুল এবং উপজেলার অনেক ক্ষুদে ছেলে মেয়েরা খেলাধূলায় আগ্রহী হচ্ছে। ভবিষ্যতেও কৃষ্ণা এমন সাফল্য ধরে রাখবে এমনটিই প্রত্যাশা গোলাম রায়হানের।

অন্যদিকে, সূতি ভিএম মডেল পাইলট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ বলেন, আমরা কৃষ্ণার মতো সেরা ফুটবলার পেয়ে অনেক আনন্দিত ও গর্বিত। আমাদের স্কুল থেকেই কৃষ্ণার যাত্রা শুরু হয়েছে। নারীরা আজ পিছিয়ে নেই সেটা আরো একবার প্রমাণ করেছে কৃষ্ণা।
সম্পাদনায়: এম এ রাশেদ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়