তাপস কুমার, নাটোর: নাটোর শহরের কাপুড়িয়াপট্টি, পিলখানা ও লালবাজার এলাকার অধিকাংশ জুয়েলার্স কারখানায় অ্যাসিড ব্যবহারের বিধি মানা হচ্ছে না। নিষেধ না মেনে এসব কারখানায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিঃসৃত হচ্ছে অ্যাসিড পোড়ানোর গ্যাস। অ্যাসিডের গ্যাসের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এসব এলাকার আবাসিক বসবাসকারী অন্তত দুই শতাধিক পরিবারের লোকজনের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, চর্মরোগ, চক্ষুসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এখানকার মানুষ। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন পথচারীসহ স্বর্ণশিল্প কারিগররাও।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এখানকার অধিকাংশ জুয়েলারি কারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। তারা অ্যাসিড ব্যবহারের বিধি-নিষেধ মানছেন না। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে স্মারকলিপি ও জুয়েলারি মালিক সমিতিকে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। তাদের অভিযোগ, কারখানার কাজে ব্যবহৃত নাইট্রিক অ্যাসিড ও সালফিউরিক অ্যাসিডের নিঃসৃত ধোঁয়া কারখানার স্বল্প দৈর্ঘ্য পাইপ দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে ঘরবাড়িতে। দরজা-জানালা বন্ধ করেও রক্ষা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫০ সালের দিকে নাটোর শহরের কাপুড়িয়াপট্টি, পিলখানা এবং লালবাজার এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি দোকান দিয়ে জুয়েলার্স ব্যবসার সূত্রপাত ঘটে। বর্তমানে এখানে ১৬২টি দোকান রয়েছে। এজন্য শতাধিক কারখানাও গড়ে উঠেছে। লালবাজার মহল্লার মো. আব্দুর রাজ্জাক বাচ্চু জানান, অ্যাসিডের ধোঁয়ায় শুধু বাতাসই বিষাক্ত হচ্ছে না, এলাকার গাছপালার ফল-পাতাও বির্বণ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া টিনের বাড়ির চালগুলো রাসায়নিক প্রভাবে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। শহরের চৌকির পাড় মহল্লার খোকন সাহা জানান, অনেক মালিক ও কারিগর রাস্তার পাশে অ্যাসিড দিয়ে সোনা গলানোর কাজ করছেন। ফলে অ্যাসিডের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে রাস্তা, ঝাঁঝে পথ চলতে খুবই কষ্ট হয়।
নাটোর জর্জ কোর্টের সহাকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) অ্যাডভোকেট মো. মাসুদ হাসান জানান, আইন অনুযায়ী রাস্তার ধারে অ্যাসিড ব্যবহার করা বেআইনি। একটি নির্ধারিত ঘরে অ্যাসিড ব্যবহারসহ ধোঁয়া নির্গমনে কমপক্ষে ১০০ ফিট পাইপ দিয়ে উপর দিকে প্রবাহিত করতে হবে। যাতে অ্যাসিডের ধোঁয়া মানুষের নাকে না লাগে বা মানুষের কোনো ক্ষতি না হয়।
কারখানায় কর্মরত অঞ্জন বসাক জানান, কারখানায় কাজ করতে গেলে নাক-মুখ জ্বালাপোড়া করে। এ কাজে কোনো জটিল রোগ হতে পারে এমন আশঙ্কা নিয়েই কাজ করতে হয় তাদের। স্থানীয় অ্যাসিড ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী জানান, প্রতি মাসে অন্তত তিন টন অ্যাসিড বিক্রি করেন তিনি। এর মধ্যে জুয়েলার্স কারখানায় মাসে অন্তত পাঁচ থেকে ছয় মন অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়।
নাটোর জেলা জুয়েলার্স মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ভবেশ চন্দ্র চক্রবর্তী জানান, অ্যাসিড ব্যবহারে জেলা প্রশাসন থেকে লাইসেন্স নেয়া থাকলেও পরিবেশ অধিদফতর থেকে অনুমতিপত্র নেই অনেকের। স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সমিতির পক্ষ থেকে সকল রকম অ্যাসিড ব্যবহারকারীকে নিষেধ করা হয়েছে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা সরকার মো. শফিকুল ফেরদৌস জানান, অ্যাসিডের ধোঁয়া মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক। এই ধোঁয়ার কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগ হতে পারে। এমনকি হৃদরোগসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পরিবেশ অধিদফতর রাজশাহী বিভাগের পরিচালক জানান, আবাসিক এলাকায় অ্যাসিড পোড়ানো যাবে না। নিয়মানুসারে প্রত্যেক কারখানা স্থাপনের সময় পরিবেশ অধিদফতরের অনুমতিপত্র নিতে হবে। নাটোরের অনেক কারখানার অনুমতি নেই। এসব অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।
জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন জানান, তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণসহ সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এ সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সজিব
আপনার মতামত লিখুন :