স্পোর্টস ডেস্ক : টিমোথি ওয়েহ যেন বুঝতেই পারছিলেন না, কী ঘটছে। তার ভাষায়, 'সত্যি বলতে, পুরো ব্যাপারটাই আমার জন্য ছিল বিস্ময়কর,।
যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় দলের এই ফুটবলার তখন ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাসের প্রতিনিধি দলের অংশ হিসেবে হোয়াইট হাউসে উপস্থিত, যেখানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন ইরানে সম্ভাব্য হামলা এবং খেলাধুলায় ট্রান্সজেন্ডার নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে। -- বাংলানিউজ
ওয়েহ বলেন, আমাদের বলা হয়েছিল, যেতে হবে। আর কোনো বিকল্প ছিল না। একটু অদ্ভুত লাগছিল। উনি যখন ইরান আর এসব রাজনীতি নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন, তখন আমার মনে হচ্ছিল—আমি তো ফুটবল খেলতে এসেছি, ভাই!”
ওয়েহ তখন যেন অন্য কোথাও থাকলেই খুশি হতেন। জুভেন্টাস এবং যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেক খেলোয়াড় ওয়েস্টন ম্যাককেনিও ছিলেন সঙ্গী—যিনি ২০২০ সালের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন নিয়ে ট্রাম্পের বিরোধিতা করেছিলেন।
তুরিন-ভিত্তিক ক্লাব জুভেন্টাসের প্রধান বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এক্সরের সিইও জন এলকান বাদে, যাকে ট্রাম্প 'চমৎকার ব্যবসায়ী' ও 'আমার বন্ধু' বলে পরিচয় করিয়ে দেন, তখন বাকি সবাইকে দৃশ্যত অস্বস্তিতে দেখা যাচ্ছিল। বিশেষ করে যখন ট্রাম্প সরাসরি প্রশ্ন করেন, 'তোমাদের দলে কি কোনো নারী খেলোয়াড় সুযোগ পেতে পারে?'
জবাব দেন জুভেন্টাসের জেনারেল ম্যানেজার ডেমিয়ান কোমোলি, 'আমাদের একটা খুব ভালো নারী দল আছে।
জবাবে ট্রাম্প বলেন, 'দেখো, এরা কত কূটনৈতিক। '
হোয়াইট হাউসের সভায় ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তনীতি নিয়ে প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক ছিল না। এর মধ্যেই একজন জিজ্ঞেস করেন—যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ক্লাব বিশ্বকাপ কিংবা ২০২৬ বিশ্বকাপ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে? নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ১৯টি দেশের নাগরিকদের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা আরও ৩৬ দেশে সম্প্রসারিত হতে পারে।
এখানেই ট্রাম্প ফিরিয়ে আনেন তার 'কাছের বন্ধু' ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, 'এটা কোনো উদ্বেগের বিষয় না,' বলেন ইনফান্তিনো। তিনি যোগ করেন, ক্লাব বিশ্বকাপ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতাই ২০২৬ বিশ্বকাপে কাজে লাগবে।
ট্রাম্প বলেন, 'আমার মনে হয় না ও (ইনফান্তিনো) ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাটা বোঝে। জিয়ান্নি, বলো তো ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কী? ও জানেই না। ও তো পুরোপুরি বিক্রি হয়ে গেছে।
ট্রাম্প সম্ভবত টিকিট বিক্রি নিয়ে বলছিলেন, কিন্তু ইনফান্তিনোর সমালোচকদের জন্য এ কথা যেন প্রতীকী অর্থও হয়ে উঠেছে।
রাজনীতি থেকে দূরে? ----
২০১৬ সালে ফিফা সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার আগে ইনফান্তিনো তেহরান সফরে গিয়ে বলেছিলেন, 'ফুটবলের বাইরে রাজনীতি থাকা উচিত আর রাজনীতির বাইরে ফুটবল থাকা উচিত। ' অথচ আজ এই কথাই যেন সবচেয়ে বেশি হাস্যকর শোনায়।
সেই হোয়াইট হাউস ভিজিট নিয়েও সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে জুভেন্টাস কোচ ইগর টিউডরকে উত্তর দিতে বাধা দেন ফিফা’র প্রতিনিধি, বলেন—শুধু ক্লাব বিশ্বকাপ ও ম্যাচ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে।
কয়েকদিন আগে, যখন 'দ্য অ্যাথলেটিক' ফিফাকে প্রশ্ন করে ক্লাব বিশ্বকাপে কেন বর্ণবাদবিরোধী বার্তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে—তারা জানায়, তারা 'রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ'। অথচ আন্তর্জাতিক ‘হেট স্পিচ’ প্রতিরোধ দিবসে এক দিনের জন্যই ফিফা সেই বার্তা প্রদর্শন করেছে।
ফুটবলে কীভাবে এত রাজনীতি? ----
রাশিয়া, কাতার, সৌদি আরব—সব জায়গায়ই যে রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত নেতাদের সঙ্গ ঘনিষ্ঠ করেছেন ইনফান্তিনো, সেটি অজানা নয়।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে পুতিনের কাছ থেকে ‘অর্ডার অফ ফ্রেন্ডশিপ’ নেওয়া, ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশাকে তুচ্ছ করে নিজের অভিজ্ঞতা টানার মতো বক্তব্য, 'ওয়ান লাভ' ব্যাজ নিষিদ্ধ করে ইউরোপীয় দেশগুলোর অধিনায়কদের হুমকি— সব মিলিয়ে ইনফান্তিনোর নেতৃত্বে ফিফার রাজনীতি-বিরোধিতার বুলি শুধু মুখেই সীমাবদ্ধ।
এখন আবার ২০৩৪ সালের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সৌদি আরবে। আর ফিফার নতুন স্পনসর সৌদি তেল <জায়ান্ট আরামকো এবং পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (নিউক্যাসলের মালিক)। মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ইনফান্তিনোর ঘনিষ্ঠতা নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে।
ফুটবল বিক্রি হয়ে গেছে ----
এই মুহূর্তে ফুটবল আর রাজনীতি আলাদা রাখার গল্পটা যেন সবচে বড় মিথ্যে। হোয়াইট হাউসের ফুটেজ এখনও অস্বস্তিকর। কোচ আর খেলোয়াড়দের মুখে স্পষ্ট অপ্রস্তুততা। বিশ্বজুড়ে রাজনীতিক, তেল-অধিপতি, অলিগার্ক, রাষ্ট্রীয় তহবিল—সবাই ফুটবল ক্লাব কিনছে। আর ফুটবলের নীতি নির্ধারকরা মাথা নিচু করে বসে থাকছে রাজনীতির দরবারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায় বললে, ফুটবল? এটা তো বহু আগেই বিক্রি হয়ে গেছে।