বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের একবছর পূর্তিতে রোববার ঢাকায় আলাদা দু'টি সমাবেশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং বিএনপি'র ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এসব সমাবেশ থেকে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দিয়েছেন দল দু'টির শীর্ষ নেতারা।
এর মধ্যে ঢাকার শাহবাগে সমাবেশের আয়োজন করে ছাত্রদল। গণ অভ্যুত্থানের পর সংগঠনটির পক্ষ থেকে প্রথমবার আয়োজিত বড় এই সমাবেশে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে আগামী নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের সমর্থন চান বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
"তারুণ্যের প্রথম ভোট ধানের শীষের জন্য হোক," সমাবেশে বলেন মি. রহমান।
সেই সঙ্গে শোনান, রাজনীতির গুনগত পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি।
একই সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগেই তারেক রহমান দেশে ফিরবেন বলে আশা প্রকাশ করেন মি. আলমগীর।
এদিকে, গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে এনসিপি। সেখানে 'নতুন বাংলাদেশ' গড়তে নতুন সংবিধান, সেকেন্ড রিপাবলিক গঠন, জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ও বিচার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার সহ ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেন এনসিপি'র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
"গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পরে বাংলাদেশে এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরা আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দ্বিতীয় রিপাবলিকের ২৪ দফা ইশতিহার ঘোষণা করছি," সমাবেশে বলেন মি. ইসলাম।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে গত বছরের তেসরা অগাস্ট এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণের সমাবেশ থেকেই এনসিপি'র এই নেতা, যিনি তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন, তিনি শেখ হাসিনার সরকার পতনের এক দফা দাবি ঘোষণা করেছিলেন।
ওই এক দফার মতো এবারের ২৪ দফা বাস্তবায়নেও দেশের মানুষের সহযোগিতা চেয়েছেন মি. ইসলাম।
গত বছরের পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে পুলিশি বাঁধার মুখে যারা কর্মসূচি পালন করতে পারতেন না বলে অভিযোগ করতেন, রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদলের নেতাদের সমাবেশ ঘিরে রোববার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে, উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষার মধ্যেই ঢাকায় একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হওয়ায় ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নগরীর সাধারণ বাসিন্দাদের।
কেমন ছিল ছাত্রদলের সমাবেশ?
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের শাসনামলে ঢাকায় সেভাবে প্রকাশ্যে বড় ধরনের সভা-সমাবেশ করতে দেখা যায়নি ছাত্রদলকে। সংগঠনের নেতাদের দাবি, ওই সময় তাদেরকে সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর সেই বাধা আর নেই। ফলে গণ অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বেশ ঘটা করেই সমাবেশের আয়োজন করে ছাত্রদল।
সমাবেশের মূল আনুষ্ঠানিকতা দুপুরে শুরু হলেও এদিন সকাল থেকেই শাহবাগের সভাস্থলে আসতে থাকেন ছাত্রদলের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতাকর্মীরা। বেলা দুইটা নাগাদ সমাবেশস্থলের চারপাশ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।
সভার নানান আয়োজন ও সাজ-সজ্জায় গণ অভ্যুত্থানে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ ও অবদান ফুঁটিয়ে তুলতে দেখা গেছে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও এই আয়োজনে বিএনপির শীর্ষ নেতারা যোগ দিয়ে বক্তব্য দেন।
এসময় নতুন ভোটারের কাছে ধানের শীষের জন্য ভোট চাইতে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশনা দেন বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
"বাংলাদেশের মানুষ বিরোধ আর প্রতিশোধের রাজনীতি চায় না। জনগণ চায় রাজনীতির গুনগত পরিবর্তন," সমাবেশে বক্তব্যে বলেন মি. রহমান।
"এই দেশে পরিবর্তন আসবেই। আর সেই পরিবর্তনের নেতৃত্বে থাকবে ছাত্রসমাজ। আমাদের ইতিহাসের সব মহান আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তারুণ্য—আজও তাই হবে। ছাত্রদলের প্রতিটি কর্মীই হবে জনগণের প্রতিনিধি, শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ," বলেন বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
একইসঙ্গে, যেকোনো ধরনের "ফ্যাসিবাদ ও চরমপন্থার" উত্থান ঠেকাতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান।
''এই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ-চরমপন্থার উত্থান কিংবা পুনর্বাসন ঠেকাতে শিক্ষার্থীদেরকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে," বলেন মি. রহমান।
সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ''আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেব লন্ডনে বসে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা করে নির্ধারণ করেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবে। গোটা বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করে আছে যে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবে।"
"তার আগে গোটা বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করে আছে, আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেব দেশে ফিরে আসবেন। তাই না? আমরা সবাই তাই চাই না? উনি আসবেন, আমাদের নেতৃত্ব দেবেন, আমাদের পথ দেখাবেন," বলেন মি. আলমগীর।
এনসিপি'র নতুন ইশতেহার
শহীদ মিনারের সমাবেশে এনসিপি যে ২৪ দফার ইশতেহার ঘোষণা করেছে, সেখানে নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক গঠন, জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ও বিচার, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা ও আইন সংস্কার, সেবামুখী প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠন সহ বিভিন্ন বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে।
"আমাদের এক দফা দাবি ছিল, আমরা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে চাই। কেবল এক ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা হটিয়ে, আরেক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা উত্থানের সম্ভাবনা জিইয়ে রেখে আমরা নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরতে পারি না," বলেন এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম।
গণ অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে এনসিপি কাজ করে যাচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
"আমরা বলেছিলাম আমরা এমন একটা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করবো, যেখানে স্বৈরতন্ত্র আর কখনোই ফিরে আসতে পারবে না। ফ্যাসিবাদ আর কখনো ফিরে আসতে পারবে না। কিন্তু আমরা দেখছি ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন হয়েছে, কিন্তু ফ্যাসিবাদী বন্দোবস্তের বিলোপ আমরা ঘটাতে পারিনি। আমরা পারিনি সেই পুরনো সংবিধানকে বাতিল করে একটা নতুন সংবিধান তৈরি করতে। আমরা পারিনি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার ক্ষমতার স্তম্ভ ছিল যেই দুর্নীতি পরায়ণ অলিগার্ক ব্যবসায়ী ও তাদের অর্থনীতিকে ভেঙে দিতে," বলেন মি. ইসলাম।
"আমরা এমন একটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে কেবল নির্বাচনের দিনে জনগণের হাতে ক্ষমতা থাকবে না, বরং রাষ্ট্র পরিচালনার সকল ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে," বলেন নাহিদ ইসলাম।
সমাবেশে অংশ নিয়ে এনসিপির নেতারা জুলাই ঘোষণাপত্রের পাশাপাশি জুলাই সনদ ঘোষণার দাবি জানান।
'এখন আমগো কেউ ডাকে না'
ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেখানে এনসিপি'র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তার বিপরীত দিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সভা দেখছিলেন রিক্সাচালক ফরিদুল ইসলাম। তার দু'চোখে ছিল একরাশ হতাশা।
"চব্বিশের যে বিপ্লবটা হইলো, সেইখানে তো আমরা রিক্সা চালকরাও ছিলাম। আমরা মেধাবি না, আমগো চাকরির দারকারও নাই, তারপরও ছিলাম," বলেন মি. ইসলাম।
জুলাই গণ অভ্যুত্থানে ঠিক কী ধরনের ভূমিকা পালন করেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকার এই রিক্সাচালক দাবি করেন যে, তিনি আহত আন্দোলনকারীদের হাসপাতালে নিতে সাহায্য করেছেন।
"যখন তারা রাস্তায় গুলি খাইয়া পড়ে থাকতো, তখন আমাগো ডাইকা বলতো: ওই মামা, আসো। হাসপাতালে নিতে হইবো। আমরা ছুইটা যাইতাম, জানের মায়া না কইরা," বলছিলেন মি. ইসলাম।
"কিন্তু আজ দেখেন, হেরা সমাবেশ করতাছে। এখন আমাগো দরকার হয় না। এখন আমাগো কেউ ডাকে না," ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন রিক্সাচালক ফরিদুল ইসলাম।
মি. ইসলাম যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন তার পাশে আরও কয়েক জন রিক্সাচালক এসে দাঁড়ান। তাদের কণ্ঠেও একই ক্ষোভ।
"বিপদের সময় আমরাই পথে ছিলাম। আমগো অনেকে গুল্লি খাইয়াও মরছে। এখন দেশ স্বাধীন হইছে, সবাই আমগো ভুইলা গেছে," বলেন হোসেন আলী নামের আরেকজন রিক্সাচালক।
সমাবেশ ঘিরে ভোগান্তি
ঢাকায় রোববার একইসঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সরকারি কর্ম কমিশনের চাকরির পরীক্ষা ছিল। এর মধ্যেই শাহবাগে ছাত্রদল, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এনসিপি এবং সোহরাওয়াদী উদ্যানে ছাত্রশিবির তিনটি বড় অনুষ্ঠান পালন করেছে। এতে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নগরের সাধারণ বাসিন্দাদের।
সমাবেশস্থল গুলো মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক হলেও সেখানে যারা যোগ দিয়েছেন তারা এসেছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে। এক্ষেত্রে অনেকেই এসেছেন বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন ভাড়া করে। ফলে সভাস্থলের আশেপাশের এলাকায় সড়কগুলোতে যানজট সৃষ্টি হয়।
"আজকে (রোববার) দুই-দু'টো পাবলিক পরীক্ষা। এরকম পরীক্ষার সময় এমনিতেই যানজট লেগে থাকে। এর মধ্যে তিন দলের সমাবেশ থাকায় অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেলে চিকিৎসক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মোখলেসুর রহমান।
সমাবেশগুলো কেন্দ্র করে আশেপাশের বেশকিছু সড়ক বন্ধ রাখা হয়েছিল। যদিও ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে আগেই ওইসব এলাকা এড়িয়ে চলার জন্য নগরবাসীকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শাহবাগে ছাত্রদলের সমাবেশস্থলের পাশের হাসপাতালগুলোতে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন, গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে তাদের অনেকেরই বেগ পেতে হয়েছে।
"হাসপাতালের পাশে এগুলা কেন করতে দেয় প্রশাসন? এসব সভা-সমাবেশ তো হওয়া উচিৎ খোলা মাঠে। তাহলে সবাই বাঁচে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নাদিরা আক্তার।
এদিকে, তিন সংগঠনের কর্মসূচিতে বাসভরে নেতাকর্মীদের আসতে দেখা গেলেও রাস্তায় তুলনামূলক কম ছিল গণপরিবহনের সংখ্যা। ফলে কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট সহ বিভিন্ন মোড়ে যাত্রীদেরকে বাস ধরার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।