সিয়াম সারোয়ার জামিল: ভারতের নিজেদের বাজারেই পেঁয়াজের চাহিদা তুঙ্গে। কলকাতাতে পেঁয়াজের দাম এখন ১০০ রুপি ছুঁই-ছুঁই। তবু শুধুমাত্র বন্ধুত্বের কারণে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি করতে রাজি হয়েছে ভারত। সামনেই রমজান মাস। গোটা দেশেই বাড়বে পেঁয়াজের চাহিদা। সেদিক থেকে দিল্লির এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য সুখবর নিয়ে এসেছে। ভারতের সিদ্ধান্তে কমতে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। পেঁয়াজ রপ্তানি নিয়ে ভারতের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের কূটনৈতিক জয় হিসেবেই দেখছেন বিশিষ্টজনেরা। তাঁদের মতে, নতুন বিদেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের দিল্লি সফরেই রচিত হয় বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায়। তারই হাত ধরে ভারত সহজেই বাংলাদেশকে তার বন্ধু দেশ হিসেবে বিবেচনায় এনে পেঁয়াজ রপ্তানিতে সম্মত হয়েছে। চিনিও রপ্তানি শুরু হতে পারে শিগগিরই।
বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জানিয়েছেন, ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি করবে। পেঁয়াজ আমদানির আগে এই খবরই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দাম কমতে শুরু করেছে পেঁয়াজের। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে বসেছিল পেঁয়াজ। বর্তমানে রাজধানী ঢাকাতে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০-১২০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে দাম ছিল ১২০-১৩০ টাকা প্রতি কেজি। অর্থাৎ দাম কমছে। তাও এখনও ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়নি। শুধু খবর পৌঁছে গেছে গোটা দেশে, তাতেই দাম কমছে। মজুদদারেরা পেঁয়াজ আমদানির আগেই নিজেদের গোডাউন খালি করতে শুরু করেছেন।
ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুখবর শুনিয়ে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত থেকে পেঁয়াজ এবং চিনি আমদানির জন্য যে প্রক্রিয়াগুলো আমরা নিয়েছি, নীতিগতভাবে ভারত সরকার সে বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে’।তার আশা, খুব শিগগরিই পেঁয়াজের ঝাঁজ কমবে। এর আগে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প, বস্ত্র ও ভোগ্যপণ্য এবং খাদ্য ও গণবিতরণবিষয়ক মন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের সঙ্গে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু টেলিফোনে১ লাখ টন চিনি ও ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ সরবরাহে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানান। ভারত নীতিগতভাবে পেঁয়াজের পাশাপাশি চিনি রপ্তানিতেও সম্মত হয়েছে।
অথচ, ভারতের বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা এখন তুঙ্গে। চাহিদার অনুপাতে ফলন হয়নি। তাই নিজেদের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে গত বছরের ডিসেম্বরে পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ভারত। পরে এ নিষেধাজ্ঞা চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে বাংলাদেশসহ আরো পাঁচটি দেশে সীমিত আকারে পেঁয়াজ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।দিল্লিতে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রকের বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে লেখা হয়েছে, রমজান মাসকে মাথায় রেখে, বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে দ্রুত পেঁয়াজ রপ্তানি করা হবে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের খাতিরে বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলংকা, মরিশাস, ভুটান, বাহরাইন ও নেপালে তারা পণ্যটি রপ্তানি করবে। বাকি দেশগুলির জন্য নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকছে।
বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে বাজারে পেঁয়াজের দাম অস্থিতিশীল। ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেই বেড়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসটির দাম। গোটা দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩০ লাখ টন। তবে গত অর্থবছরে ৩৪ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমাদের দেশেই উৎপাদন হয়। তবে মাঠ পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যন্ত যেতে এক-চতুর্থাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয় কিংবা শুকিয়ে কমে যায়। ফলে ভোক্তারা তাদের চাহিদা মতো দেশীয় পেঁয়াজ পান না। এছাড়াও পেঁয়াজ সংরক্ষণেরও সমস্যা রয়েছে বাংলাদেশে। ফসল ওঠার সময় বাজারে চাহিদা কমে গেলেও অন্য সময় মারাত্মক চাহিদা বাড়ে দেশীয় পেঁয়াজের। গত বছরের মার্চে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। তবে এপ্রিলের মাঝামাঝি নিত্যপণ্যটির দাম বাড়তে শুরু করে।
জুনের শুরুতে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়ে হয় ১০০ টাকা। তখনই সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়। তারপর বাংলাদেশ আমদানি করে ৭ লাখ ৫ হাজার ৪৩৭ টন পেঁয়াজ। তবে গত বছর ৮ ডিসেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি করার আগে পর্যন্ত মোট ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ২৯১ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়েছিল কৃষি দপ্তর। কিন্তু আমদানি করা হয় অনেক কম পেঁয়াজ।বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাষ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবিষয়ে সঠিক পরিকল্পনামাফিক কাজ করে চলেছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চলছে পেঁয়াজ চাষ।পেঁয়াজ চাষে সাফল্য এলেও চাহিদা রয়েই গিয়েছে। তাই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা বাংলাদেশের জন্য জরুরি।
এদিকে,ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির খবর জানাজানি হতেই বাংলাদেশের বাজারে হঠাৎ পণ্যটির সরবরাহ বাড়তে শুরু করেছে। দেশি পেঁয়াজেরও দাম কমছে। দেশি পেঁয়াজের দাম কমেছে কেজিতে অন্তত ১০ টাকা। ঢাকা শহরে পাইকারিতে ১০০ ও খুচরায় ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ এখন ৯০ ও ১০০ টাকায় মিলেছে। আমদানি শুরু হলে দাম আরও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় বেশ কিছুদিন ধরেই স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। সম্পূর্ণ দেশি পেঁয়াজ দিয়েই বাজারে ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। সামনেই রমজান মাস। প্রতি বছরই গোটা দেশে এ সময় পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদা থাকে। তাই ভারত থেকে পণ্যটি আমদানির জন্য আগে থেকেই অনুমতিপত্র (আইপি) নিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। এলসি খোলা থেকে শুরু করে পেঁয়াজ আমদানির জন্য আমদানিকারকরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন।
গত বছর ৮ ডিসেম্বরে পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ভারত। অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ বাড়াতে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল সাধারণ মানুষের কপালে। রমজান মাস ও ঈদের আগে সুখবর নিয়ে এসেছে বাংলাদেশে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানিতে সম্মতির বার্তা। কূটনৈতিক মহলের খবর, ভারত বাংলাদেশকে শুধু পেঁয়াজই রপ্তানি করছে না, পেঁয়াজের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আরও উন্নত করারও বার্তা দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ’ুদেশের সম্পর্ককে উন্নিত করেছেন আত্মীয়তার গভীর বন্ধনে। পেঁয়াজ বা চিনি আমদানি-রপ্তানি তারই সূচক মাত্র। বন্ধুত্বের শিকড় এখন অনেক গভীরে।
আপনার মতামত লিখুন :