শিরোনাম
◈ ইসরা‌য়ে‌লি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বাড়ি লক্ষ্য করে ৫০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়লো ইরান ◈ ক্লাব বিশ্বকাপ ফুটব‌লে বায়ার্ন মিউ‌নি‌খের রেকর্ডগড়া জয় ◈ আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে সিরিজ জিতলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ◈ দেশজুড়ে শিক্ষক সংকট, শূন্য পদ ১ লাখের বেশি: এনটিআরসিএর মাধ্যমে আসছে ৬ষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি! ◈ পরিবারসহ গোপন বাঙ্কারে লুকিয়েছেন খামেনি : ইরান ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট ◈ বাংলা‌দেশ এখ‌নো টেস্ট ব্যাটিং শিখছে, তাই চিন্তিত নন সিমন্স ◈ বাংলাদেশের বিরু‌দ্ধে শ্রীলঙ্কার টেস্ট দল ঘোষণা ◈ ইরানের নতুন সামরিক কমান্ডার কারা? ◈ আইন সংশোধন, নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তি ও প্রশিক্ষণে আটকে নির্বাচন পরিকল্পনা ◈ খামেনির বিরুদ্ধে ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ পরিকল্পনা বন্ধ করলেন ট্রাম্প?

প্রকাশিত : ২০ জানুয়ারী, ২০২৪, ০১:৪৪ রাত
আপডেট : ২০ জানুয়ারী, ২০২৪, ০১:৪৪ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কেন দেশ ছাড়ে মানুষ?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: অনেকে জিজ্ঞেস করেন যে, বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা দেশ ছাড়তে চায় কেন? কী কারণে ছাড়তে চায় তার অনেকগুলো কারণ আছে। অন্তত একজনের দেশ ছাড়া নিয়ে একটি কারণ আমার কাছে বড় অদ্ভূত লাগলো। একটি ছেলের সঙ্গে আমার একটি ক্লাবে পরিচয় হয়। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বেশ বড় অঙ্কের বেতনে চাকরি করে। তার স্ত্রী আরেকটি বহুজাতিক কোম্পানিতে বড় বেতনে চাকরি করে। অথচ দুজনেই চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে। তাদের যে অর্থ আছে তাতে ঢাকা শহরে খুব ভালোভাবে থাকা যায়, গাড়ি মেইন্টেন করা, এপার্টমেন্ট ক্রয় ইত্যাদি সবকিছুই খুব সচ্ছলভাবে করা সম্ভব। কিন্তু তারপরেও তারা চলে যাচ্ছে। কারণ উনার কাছে মনে হয়েছে, নিজের দেশে কোনো মর্যাদা নেই। একদিনের একটি ঘটনায় নিজের দেশে নিজেকে মর্যাদাহীন নাগরিক বলে উনার মনে হয়েছে। 

রাতের বেলা ওষুধ কেনার প্রয়োজনে বাইরে গিয়েছেন। ফার্মেসীর বাইরে গাড়ি রেখে ওষুধ কিনে ফেরার সময় একজন পুলিশ কনস্টেবল তার সঙ্গে খুব বাজে ব্যবহার করে যে কেন ওখানে তিনি গাড়ি রাখলেন। অথচ উনার গাড়ির সামনে একটি সরকারি গাড়িও দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলো। কিন্তু তাকে কিছুই বলা হচ্ছে না। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলে কনস্টেবল বলেন ওটা সরকারি গাড়ি। সেদিন থেকে উনার মনে হয়েছে সরকারি লোকজন ছাড়া আসলে আর কারো কোনো মর্যাদা এই দেশে নেই। তাই উনাকে হয়তো সরকারি চাকরি করতে হবে, নয়তো সরকারি রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে ঢুকতে হবে, অথবা অনেক বড় ব্যবসায়ী বা সেরকম কেউ হতে হবে, যাদের অনেক দামি গাড়ি রাস্তায় দেখলেও পুলিশ আসলে কিছু বলে না। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে উনি চলে যাচ্ছেন এবং তার ভাষ্যমতে, যেখানে যাবেন সেখানে অন্তত এইটুকু অপমান হতে হবে না। তিনি যে দেশে যাচ্ছেন আইন সেখানে সবার জন্য সমান। 

আমাদের সময়কালেও আমরা দেখেছি কারা বিদেশে যেতো। বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার যাদের স্বচ্ছল জীবন ছিলো, বড় ব্যবসায়ী, বড় আমলার সন্তানরা বিদেশ চলে যেতো। অর্থাৎ ধনী শ্রেণির ছেলেমেয়েরাই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ইত্যাদির মতো দেশে পড়তে যেতো। আর কমিউনিস্ট পার্টি করা লোকজনের ছেলেমেয়েরা, আত্মীয়-স্বজনরা সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে যেতো। যদিও সেটা এখন বদলে গেছে। বর্তমানে প্রায় প্রতি ঘর থেকে শুনতে পাবেন বিদেশে ছেলেমেয়েরা পড়ছে। এমনকি অতি সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরাও। কেন পড়ছে? ছেলেমেয়েরা যেতে চায় বলেই বাবা-মা বাধ্য হচ্ছে নিজে কষ্ট করে, নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে হলেও বিদেশে পড়াতে। ছেলেমেয়েরা বাইরে চলে যাওয়ার একটা কারণ হিসেবে আমার কাছে যেটা মনে হয় তাহলো তারা এখানে কোনো নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। এক বিসিএস ছাড়া আর কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টর এখনো এতো বড় হয়নি যে বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়েকে ভালো বেতনে চাকরি দেবে। পঞ্চাশ হাজার বা একলাখ টাকা মাসে এদেশে পড়াতেও ক্ষেত্র বিশেষে খরচ হয়। কিন্তু তা করতে গিয়ে মাসে ১৫ বা ২০ হাজার টাকার একটা চাকরিও জোটে না। আবার যে চাকরি জোটে সেখানে মালিকদের যে অ্যাটিচিউড,বাংলাদেশের ব্যক্তিখাতের মালিকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতি নিম্ন সংস্কৃতি থেকে আসা। সেখানেও তারা কাজের কোনো মর্যাদা পায় না। খুব কম ছেলেমেয়ের ভাগ্যেই সরকারি চাকরি জোটে এবং বেসরকারি ভালো কাজ জোটে। কেউ কেউ হয়তো বলেন, নিজে কিছু করছেন না কেন। সেটাইবা কতজনে করতে পারে? সবাই উদ্যোক্তা হয় না। ফলে সামগ্রিকভাবে একটা খুব হতাশার চিত্র আমরা চারদিকে দেখতে পাচ্ছি। 

একটা সময় পিএইচডি করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিদেশে যেতেন। চিত্রটা কেন পাল্টালো? কেন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এমনকি গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরাও বিদেশে চলে যাচ্ছে? এটা বোধহয় একটা চিন্তাভাবনার ব্যাপার আছে যে কেন ছেলেমেয়েরা দেশে থাকতে চায় না? দেশে কর্মসংস্থান আসলেই কিন্তু কমে গেছে। আশির দশকের চেয়ে অনেকাংশে ব্যক্তিখাতের দাপট কমে গেছে। এর বাইরে নানা ক্ষেত্রে বড় বড় দুর্নীতির ঘটনাগুলো ছেলেমেয়েদের আসলে হতাশ করে। আমরা যতোটা মনে করি যে ছেলেমেয়েরা হয়তো এসব খেয়াল করে না আসলে তারা সবকিছুই খেয়াল করে। আমাদের বিদ্বেষপূর্ণ,বিভাজিত, কদর্যভাষার যে রাজনীতি আছে সেটাও আমি নিজে খেয়াল করে দেখেছি অনেক ছেলেমেয়েকে হতাশ করে। তারা বলে এমন একটি পরিবেশ সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবে থাকার জন্য অন্তরায়। তাহলে আসলে করণীয়টা কী? বড় চাকরি বা ভালো ব্যবসা করছে এমন মানুষকেও আমি চলে যেতে দেখেছি। তাদের ভাষ্য হলো ছেলেমেয়েকে ভালো পরিবেশে লেখাপড়া করাতে চায়। তারা উন্নত দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে কারণ সন্তানের উন্নত লেখাপড়া এবং বৃদ্ধ বয়সে উন্নত চিকিৎসার। দেশের প্রতি আসলে হয়তো মায়া কমে গেছে। অনেকে বলেন, মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি মেধা, সততার বা ত্যাগ-তিতিক্ষার যথাযথ মূল্যায়ন আমাদের দেশে হচ্ছে না। রাজনীতিবিদদের মতে দলের ত্যাগী কর্মীর কোনো মূল্যায়ন নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেখা যায় মেধাবী ছাত্রের কোনো মূল্যায়ন হচ্ছে না, যে ছেলেটি শিক্ষকদের পা চাটতে পারছে তাকে হয়তো ফার্স্টক্লাস দিচ্ছে, আরেকজনকে দিচ্ছে না। যদিও এটা সাধারণ চিত্র নয়। কিন্তু এই কথাগুলো নানা সময় আসে। 

সরকারি-বেসরকারি খাতে সর্বত্রই এই কথাগুলো উচ্চারিত হয়। এমনকি বিসিএস পাস করা ক্যাডার ছেলেমেয়েরাও বলে তারা ভয়ঙ্কর হিংসার শিকার হয় ব্যাচমেটদের দ্বারা। প্রমোশনের সময় বঞ্চিত হয়। প্রচুর সরকারি কর্মকর্তাও বলেন রিটায়ার্মেন্টের পর তারা বিদেশে চলে যাবেন। একটা কারণ হলো চিকিৎসা আরেকটা কারণ হলো সন্তানরা আগে থেকেই বিদেশে। আসলে নানা ধরনের সূত্র মানুষের সামনে আছে। ক্ষমতাকাঠামোর  ভেতরে যারা আছে তারাও কিন্তু একাধিক পাসপোর্টের জন্য দুই নৌকায় পা দিয়ে আছে। এছাড়াও আমরা দেখি শিক্ষক, আমলা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকদের একাধিক পাসপোর্ট। বাংলাদেশ আসলে কারো কারো কাছে টাকা বানানোর মেশিন। তারা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এই যে গোষ্ঠীটা আছে যারা বড় আমলা, বড় ব্যবসায়ী তারা আসলে এখানে টাকা বানানোর জন্য থাকে আর বাস করার চিন্তা করে উন্নত দেশে। ফলে এই দেশটার আসলে সেই অর্থে কোনো ঔনারশিপ দাঁড়ায়নি। সাধারণ মানুষ থাকে। থাকতে হয় তাদের। আমাদের আর যাওয়ার জায়গা নেই, তাই আমরা আছি এবং আমরা হয়তো এখানেই থাকবো এখানেই মরবো। কিন্তু সেই অর্থে দেশের প্রতি ঔনারশিপ উপরের স্তরের মানুুষের অনেক কম। আরেকটা বড় কারণ হলো এর একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। এটা হলো একজনের ছেলেমেয়ে গেলে আরেকজনের ছেলেমেয়ে যেতে চায়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই দেশে থাকার প্রবণতা কমছে। তাহলে করণীয় কী? করণীয় হলোÑ দেশে  এমন একটা ব্যবস্থা আনা যেন মানুষ এদেশে স্বাভাবিক স্তরের সুশাসন দেখতে পায়। 

একটা সুশাসিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু সেটা নানা কারণে হচ্ছে না। সুশাসন না হওয়ার রাজনৈতিক অনেক কারণ আছে, তার মধ্যে শত্রুতা, বিদ্বেষও আছে। সমাজে ন্যায়বিচার হোক, মানুষ তার ন্যায্য পাওনা পাক, হাসপাতাল, পুলিশ, সরকারি অফিসে গেলে সদ্বব্যবহারটুকু পাক মানুষ এটা প্রত্যাশা করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুর্নীতিতে মানুষকে অভ্যস্ত করে ফেলা হচ্ছে। ইলেকট্রিসিটি বিল, ওয়াসার বিল, জমির খাজনা এগুলো গিয়েও ঘুষ দিতে হয়। তাহলে মানুষ কীভাবে দেশটাতে নিজের ঔনারশিপ তৈরি করবে? সে নিজের দেশকে দিতে চাচ্ছে, তারপরও তাকে ঘুষের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারি অফিসে হয় ঘুষ দিতে হবে, অথবা আপনার বড় পরিচয় বা পরিচিতি থাকতে হবে না হলে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। এই জায়গা থেকে কি দেশটাকে বের করে আনা যায়? ইউটিলিটি সার্ভিস বা সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি অন্তত ঘুষ বা হয়রানিমুক্ত করা যায়, তাতেও অনেক মানুষ স্বস্তির জায়গা পাবে। পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার ফেজবুক পেইজের ভিডিও কন্টেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়