দেবীপ্রসাদ ত্রিবেদী: কলকাতার শিল্পী অনুপম রায় গেয়েছিলেন, ‘বাড়িয়ে দাও তোমার হাত; আমি আবার তোমার আঙ্গুল ধরতে চাই...।’ ‘তোমার গালে নরম দুঃখ আমায় দু’হাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ...’ তার গাওয়া। করুণ সুরে গেয়েছিলেন ‘আমার দুঃখগুলো ডালিমের মতো... লালের জমাট কেউ ভাঙতে পারে না...।’ এসব গান নিজেই লিখতেন। তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সাবলীল ভাষায় জটিল উপমা। যা শ্রোতাকে ভাবতে বাধ্য করায়। তার গলায় বিশেষ কিছু নেই। এজন্যই হয়তো গান গাইতেন হৃদয় দিয়ে। তিনি যখন গেয়ে ওঠেন, ‘আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে আছো...’ কিংবা ‘আমি কি তোমায় খুব বিরক্ত করছি বলে দিতে পারো না আমায়...।’ সেই গান হয়ে ওঠে কোটি মানুষের আর্তনাদ।
তার লেখা, তার গাওয়া গানগুলো হয়ে উঠত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ব্যাকুলতা আর দুঃখবোধের অভিধান। তার গান শুনিয়ে পছন্দের মানুষকে প্রেমে ফেলেছে হাজার যুগল। প্রেমিক/প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়া রাতে, ‘আজ রাতে বলা হবে না আমি আছি... অন্য কেউ থাকবে কাছাকাছি...’ শুনে চোখ ভেজানো মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম হবে না বলেই মনে হয়। গলায় যার এত প্রেম, এত দরদ, এত বিষাদ অথচ তার সংসার টিকল না। তার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ের সংখ্যা বিশ পঁচিশ হাজারের কম হবে না। অথচ সেই কি না একজনের সঙ্গে থাকতে পারলেন না।
এখানেই জীবন আর সংসারের পার্থক্য। কারো গান শুনে প্রেমে পড়া যায়। কারো অভিনয় দেখে প্রেমে পড়া যায়। কারো লেখা পড়ে প্রেমে পড়া যায়। কারো চেহারা দেখে প্রেমে পড়া যায়। প্রেমে পড়তে একটু আবেগ লাগে। কিন্তু সংসার? সংসারে লাগে বিবেক। ধৈর্য্য। মমতা। আর প্রচুর ছাড় দেওয়ার মানসিকতা। ছাড়টা কাকে দিতে হবে? অবশ্যই সৃষ্টিশীল মানুষটার সঙ্গী কিংবা সঙ্গিনীকে। এই অনুপম গান গেয়েই অনুপম হয়েছেন। গান লিখে অনুপম হয়েছেন। সুর দিয়ে অনুপম হয়েছেন। কিন্তু এই যে গান লেখা, সুর দেওয়া, মিউজিক করা এবং গাওয়া এগুলো কি এতই সহজ? হও বললেই হয়ে যায়? একটা লিরিকের জন্য তাকে কলম কামড়াতে হয়েছে রাতের পর রাত। সুরের জন্য উদাস হয়ে বসে থাকতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর দিনের পর দিন করতে হয়েছে রিহার্সাল। তারপরই আমরা প্রেমে পড়ার মতো অনুপমকে পেয়েছি।
অনুপম একটা গানের জন্য বিশ পঁচিশটা রাত নির্ঘুম কাটালেন, এই সময়ে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে জোছনা দেখতে পারেন নাই। বৃষ্টিতে ভিজতে পারেন নাই। আইসক্রিম খেতে পারেন নাই। হয়তো ঘরে বাজার আছে কি নেই তাও জানতে পারেন নাই। কিংবা স্ত্রীর টুকটাক অসুস্থতার খবরও পৌঁছায়নি তার ধ্যানমগ্ন স্টুডিওতে। তার স্ত্রীকে এসব ছাড় দিয়েই অনুপমকে ভালোবাসতে হয়েছে। একই কথা শ্রেয়া ঘোষাল কিংবা মোনালী ঠাকুরের স্বামীর বেলাতেও খাটাতে হবে। একটা পাহাড় যত বড় পাহাড় হয়, তার পাশে তত বড় খাঁদ থাকে। একইভাবে যে শিল্পী, লেখক যত বড় শিল্পী কিংবা লেখক হন তার জন্য কারো ত্যাগটাও হতে হয় ঠিক ততো বড়ই।
সৃষ্টিশীল মানুষকে ভালোবাসার আগে নিজের সঙ্গে একটু আলাপ করে নেবেন। নারী-পুরুষ সবাইকে বলছি। যার সৃষ্টিকে আপনি ভালোবাসছেন তার সৃষ্টিটা সৃষ্টি হয়ে ওঠার সংগ্রামকে ভালোবাসতে পারবেন তো? নিজের হাজারটা পছন্দ ত্যাগ করতে পারবেন তো? যে সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে তার কাছে ততোটুকই সময় চাইবেন, যতোটুকও সে দিতে পারবে। ফেসবুকে ২৮-১১-২৩ প্রকাশিত হয়েছে।