অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: একটা ভিডিও ভাইরাল হতে দেখলাম। এক সাংবাদিক সদ্য প্রকাশিত এইচএসসির প্রকাশিত ফলে জিপিএ-৫ পাওয়া একটি মেয়েকে ‘আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি’ ইংরেজিতে বলতে জিজ্ঞেস করছে। মেয়েটি পারেনি বলেই ভিডিওটি নেট দুনিয়াতে ছেড়ে দিলো। এভাবে একটি মেয়েকে পাবলিকলি হেয় করা যে কতো বড় অন্যায়। অথচ তার হয়তো কোনো বিচার হবে না। শুধু একবার ভাবুন, মেয়েটি আপনার কন্যা, বোন বা পরিবারের কেউ। আপনার কেমন লাগবে আর ওই মেয়েটির কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে একটু ভাবুন। এই মেয়েটির এইটা না পাড়ার জন্য তার দায় কতটা আর সমাজ বা এই রাষ্ট্রের দায় কতোটা? Oxfam IBIS Ges Street Child টক এর সাপোর্ট-এ ওয়েভ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন ২০২২ সালে খুলনা এবং রাজশাহীর ৮৮টি গ্রামে, ৫-১৬ বছর বয়সী ১৫৩৩ জন শিশুর উপর একটি সমীক্ষা চালায়। সেই জরিপে দেখা গিয়েছে যে ১৬.৭৮ শতাংশ ছেলে এবং ১৫.২২ শতাংশ মেয়ে মেয়ে ইংরেজি পড়তে পারে না এবং একই শতাংশ ইংরেজি বলতে অক্ষম (আমাদের অনেক বড় বড় মানুষরাও দেখে ইংরেজি পড়তে দেখলে আমাদের শুনতেও লজ্জা লাগে)। এছাড়াও, ৮৪.৮৫ শতাংশ ছেলে এবং ৮২.৮৬ শতাংশ মেয়েরা ইংরেজি পাঠ্য বোঝার জন্য লড়াই করে। এতে আরও দেখা গেছে যে ১০.২৮ শতাংশ ছেলে এবং ৮.৭১ শতাংশ মেয়ে বাংলা পড়তে পারে না এবং ১৪.১৯ শতাংশ ছেলে এবং ১৩.০৬ শতাংশ মেয়েরা গণিতে single digits শনাক্ত করতে পারেনি। এর অর্থ হলো ওই মেয়েটি একা নয়। আমরা যেদিন থেকে ক খ গ ঘ শিখি, সেই দিন থেকেই আমরা ধ ন প ফ শিখি। যেই দিন থেকে স্কুলে বাংলা বই পড়ি সেই দিন থেকে স্কুলে ইংরেজি বইও পড়ি। তবুও কেন আমরা ইংরেজি পারি না? ইংরেজি শুধু নয়, আমরা বাংলাতেও দুর্বল। ইনফ্যাক্ট আমরা ভাষাতেই দুর্বল। তবে ইংরেজি বিদেশি ভাষা হওয়ায় বিশেষভাবে দুর্বল। এর মূল কারণ আমাদের স্কুলগুলোতে ইংরেজির ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় না। যিনি ইংরেজি পড়ায় তিনি নিজেই ইংরেজি প্রায় জানেন না বললেই চলে। তার বিদেশী ভাষা পড়ানোর যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে তাও আমরা ফলো করি না। ইউরোপের যে যেই দেশেই পড়ুক না কেন তাকে নিজ দেশের ভাষা ছাড়াও অন্য একটি ইউরোপিয়ান ভাষা শিখতে হয়।
সেটা শুরু ক্লাস ওয়ান থেকে না। ক্লাস ওয়ান থেকে মাতৃভাষা শিখে। ভিন দেশের ভাষা শেখা শুরু হয় একটু পড়ে। কিন্তু যখন থেকে শেখে এর মধ্যেই মোটামোটি ভাষাটি জেনে ফেলে। আমার স্ত্রী ইতালিয়ান ভাষার বাইরে জার্মান ভাষা শিখেছিল। এটা কাজে লেগেছিল আমরা যখন জার্মানিতে প্রায় ২ বছর ছিলাম। কিছুদিনের মধ্যে আমার স্ত্রী প্রায় জার্মানদের মতো জার্মান বলতে পারতো। অথচ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়েও আমরা মোটামোটি শুদ্ধভাবে ইংরেজি বলতে লিখতে তেমন পারি না। এখন পারি না বলে কি কারিকুলাম সহজ করলে পারা হয়ে যাবে? নাকি শেখানোর জন্য ইউনিভার্সাল যেই পদ্ধতি আছে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে এবং একই সঙ্গে ভালো মানের ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা করাদের ইংরেজির শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিতে হবে। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে পড়া এক ছাত্রনেতার যেই ইংরেজি শুনলাম, তাতে আমার সন্দেহ হয় তারা কতোটা ভাষা শিখতে পেরেছে। আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই এমন।
কিন্তু এর মূল কারণটাকে রিপেয়ার করার চেষ্টা কখনো করিনি। সেটা হলো ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। ভালো শিক্ষক পেতে হলে ভালো বেতন দিতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো সূত্র নেই। এই সহজ সিম্পল সূত্রটি বোঝা কি এতোই কঠিন? আসলে আমরা সবাই বুঝি। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকদের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের উপকার করা নয়। And there lies the root of all the problems. লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়